উত্তর কলকাতা আসলে একটা জ্যান্ত আর্কাইভ। সজীব মিউজিয়াম। মিউজিয়াম নাকি তৈরি হয়েছিল মানুষের স্বভাবগত প্রদর্শনীর চাহিদা থেকে। মানে, বিশেষ কিছু জোগাড় করে তা লোক দেখানো! বল দিকি কোনো কথা হল? সে অর্থে যা মিউজিয়াম তো বটেই। পিয়ের নরা বলেছিলেন স্মৃতি যেখানে শেষ, সেখানে সংগ্রহশালার শুরু। কী অদ্ভুত না? যতদূর মনে পড়ছে, পড়ছে। যেখানে মনে পড়বে না, নমুনা দেখে নিলেই হয়। আজকাল যেমন সখের “হোর্ডিং”(hoarding) চালু হয়েছে। মানে পছন্দের জিনিস জুটিয়ে আনা। তা তো শুধু কেনা মূল্যে হয় না। জুটিয়ে আনা, জমিয়ে রাখার কোনো শেষ নেই।
প্রতিটি পদার্থে মুহুর্তের নাম সই করা। ধুলি ধুসরিত কাঁথা ভরা পুরনো দিনের রঙচটা তোরঙ্গ। ভিতরে খোকার আঁতুড়ের জামা, তোরঙ্গের বয়েস ভারতের স্বাধীনতার চেয়ে কিছু বেশি। ফেলবে কেমন করে? ঐ তোরঙ্গে দেশভাগ, মহাত্মা গান্ধীর গুলি খাওয়া, খোকাকে প্রথম বার কংগ্রেস আমলে পুলিশে ধরা জমে আছে। এই তোরঙ্গেই খোকার মেয়ের শীতের জামা থাকে এখন। স্মৃতি দৈনন্দিনে ব্যবহৃত। তাই জ্যান্ত। প্রতি মুহুর্তেই। তাই স্মৃতির শেষ হয়েও হচ্ছে কই? বরং বাড়ছে পলে-অনুপলে। কলিকাতা চলিয়া গেছে, উত্তর কলকাতা রহিয়া গিয়াছে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও সিংহমুখ রাস্তার জলের কলে ঠেসান দিয়ে, লোকে বলাবলি করত, “এই কী গো শেষ গান?” নয় নয় করে সাড়ে তিনশো বছর হতে চলল।
এখন অন্য গানের লাইন দিয়ে একই প্রশ্ন করে। যা বোঝা যাচ্ছে এ যাবার নয়। ইংলন্ডের রানির মতন ধরন। রাজত্ব চলছে তো চলছেই। বুড়ি মরবি কবে,তোর স্মৃতি ফুরোবে কবে ইত্যাদি কুটকচালি চলতেই থাকে। সবের মাঝে উত্তর কোলকাতায় সাবেক স্মৃতি শেষ হবার বদলে শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে গঙ্গাচ্চান করে। পারে দাঁড়িয়ে দেখে কে? অকাজের লোক। আধুলির মতন কমন ম্যানেরা। কয়েকটা কাজের লোক যে একেবারে থাকেনা তা নয়। তবে তারা পথ চলতি। আসল যাদু জানে ঐ যারা অসময়ে বসে আছে, খাঁ খাঁ দুপুর। চিল উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে গায়ে গায়ে লাগা ছাদ আর জড়ামড়ি করা অসংখ্য ধুলোমাখা তারের ওপর। ধুলোমাখা আকাশে। এক ঝাত থেকে অন্য ছাতে বয়ে যাচ্ছে পড়শি ছাপার শাড়ি। সমস্ত দিন কেউ আসেনি ছাতে, কিন্তু গলির মুখের চায়ের দকান ভরতি ছিল।
বিশাল পাঞ্জাব লরি আর অকুতোভয় ভ্যান রিকশোর গায়ে পড়া ভাব থেকে নিজেকে বাঁচাতে বাঁচাতে আপনি যখন একখানা ফুটপাতে উঠলেন, দেখলেন ঝরোখা কাটা বারান্দা। দরোজায় মকর মুখ কড়াগাছি। তলায় চাবির ফুট। দেখে বোঝা যায়, চাবি খুব বেশি পড়ে না এই বাড়ি। পাশে এতটুকুন সাদা পাথরে টানা হাতের বাংলা হরফ, কমলা ভবন। কেন যে মন উড়ে যায়, কোথায় যেন, কবেকার সেই পিছন দিকের পাতায়। যেসব গল্পকে আজকাল বলে পিরিয়ড পিস। পুরনো সব সেট সেটিং। পুরনো সব মুখের বুলি, রাস্তাঘাটের আওয়াজও একেবারে পুরনো। এমন কমলা ভবনের দরোজায় তখন পুরনো দিন নবীন যুবক। জ্বল জ্বল করছে মুখখানা। বাড়িখানা কিশোরী বয়েসি। ঝুল বারান্দা থেকে বুগেনভিলিয়া ঝুলিয়ে তামাশা করছে। জাফরির ফুলের ছায়া বারান্দার ভিতরে পড়ে বিকেলের পর। সারি সারি টবে সাজানো থাকে সখের গাছ।
রোদ তাদের মাথা ছুঁইয়ে আনমনা হয়ে বেহালা শোনে পাশের বাড়ির। রোজ বাজে। নোনা লাগা একখানা চিলেকোঠা ঘর, তার একখানা জানালা খোলা। হাওয়া আসে, সুর বেরোয়। রোদ কেবল সুর দেখতে পায়। অথচ খানিক পরেই সুর ডুবে যাবে শাঁখের আওয়াজে। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো আজ। গঙ্গার দিকে বিশাল একখানা পেঁচা ঊড়ে যায়। উত্তর কলকাতা ঘুমিয়ে ছিল কদিন মাত্র, এই বার জাগা। কালীপুজো আসছে।
গগন চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৯০ সালের তেরোই জানুয়ারি, উত্তর কলকাতা তথা বাগবাজারে। এই অঞ্চলেই তার স্কুল কলেজ জীবন মিলিয়ে আঠাশ বছরের আয়ু। উত্তর কলকাতার সামগ্রিক জলবায়ু গঙ্গার মতো অনন্ত স্রোতে বড় করে তুলেছে তাকে। পারিবারিক ঐতিহ্য ও পারিপার্শ্বিক স্রোতের সঙ্গে সরাসরি সান্নিধ্য তার দেখা শেখার মূল পাঠ। বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী ও সামান্য সময়ের জন্য সমাজ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণামূলক শিক্ষা তার এই অনুসন্ধিৎসাকে ইন্ধন জোগায়।
এই রাজবল্লভপাড়ায় সবারই এরকম শখ আছে। শখ ব্যপারটা কী জানতে চাইলে বাড়িতে বলেছে খুব ভাল্লাগে যেটা করতে, অথচ করলে কোনও পয়সা পাওয়া যায় না, সেটাই শখ। এসব শুনে বুঝেছে এই যে তাঁর রাজবল্লভকে রাজগল্লভ বলতে ভাল্লাগে। এটাও শখ। বুড়ো কর্তা বলেছে রাজা রাজবল্লভ আসলে লোক ভাল ছিল না। সেই যে সিরাজদৌল্লা বাংলার নবাব, তাকে ঠকিয়ে ইংরেজদের সাহায্য করেছিল যে, মীরজাফর, তারই প্রাইভেট সেক্রেটারি ছিল রাজবল্লভ, বাড়ি চুঁচুড়া । এইবার নবাব তো মরে গেছে, মীরজাফর ইংরেজদের থেকে মেলাই জিনিসপত্র না খেতাবও পেয়েছে। রাজবল্লভকে সুতানুটিতে কিছু জায়গা টায়গাও দিয়েছে। কিন্তু যে রোগ হয়েছে তার নাম সন্দেহ বাতিক। খালি খালি সন্দেহ করে, এই বুঝি কেউ মেরে ফেললে। সন্দেহ পড়ে রাজবল্লভের ওপরে। সে যদি ‘মীরজাফরি’ করে, এই ভয়েই ঘুম উড়ে যায়। খুন করতে লোক পাঠায় রাজবল্লভের বাড়ি। সে ততক্ষণে সাঁ! গঙ্গা দিয়ে পালিয়ে পালিয়ে ফের সো-জা চুঁচুড়া। সে মাঝে মাঝে ভাবে, এখনও যদি থাকত ওই রাস্তাটা! সে একবার যেত। শখের ব্যপারটা তাঁর ষোলো আনা আছে।যেসব গল্পকে আজকাল বলে পিরিয়ড পিস। পাশাপাশি হাঁটতে থাকে তিনশো বছর আগের কলকাতা, গমগমে চিৎপুর, হরেক নকশা, খেউড় আর নেশা হুজ্জুত করা পক্ষীর দল।
বই : সাকিন সুতানুটি
লেখক : গগন চক্রবর্তী
প্রচ্ছদ- রনিত মাইতি
শিরোনামলিপি- পার্থ দাশগুপ্ত
অলংকরণ- ডেসমন্ড ডয়েগ
৯ঋকাল বুকস
২৫০ টাকা
Leave a comment