বইয়ের নামঃ সমগ্র শিশুসাহিত্য
লেখকঃ সুকুমার রায়
প্রচ্ছদঃ সত্যজিৎ রায়
প্রকাশনীঃ আনন্দ পাবলিশার্স
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৬৮
মুদ্রিত মূল্যঃ ৭৫ রূপি
“হাঁস ছিল, সজারু (ব্যাকরণ মানি না),
হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে- ‘বাহবা কি ফুর্তি।’
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি।”
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি তখন। পথের পাঁচালী পড়ে বই পড়ার শুরু হয়েছে মাত্র। পড়ার জন্য বই খুঁজি লাইব্রেরিতে। বর্তমানের মতো এত সহজলভ্য ছিল না। লাইব্রেরিতে একটি বই দেখলাম ‘সমগ্র শিশুসাহিত্য’। পড়ার তাগিদেই কিনে নিলাম। তারপর শুরু হলো অদ্ভুত অদ্ভুত সব রচনার সাথে পরিচয় । কৈশোরের মন উৎফুল্ল হয়ে উঠলো।
জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের সকল শিশুতোষ রচনা এক মলাটে। ছড়া-কবিতা, গল্প, নাটক, জীবনীসহ বিবিধ রচনা বইটির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। আবোলতাবোল, খাই খাই, হ য ব র ল, পাগলা দাশুর সাথে পরিচিত হয়েছিলাম এই বইয়ের মাধ্যমেই। প্রত্যেকটি গল্প-কবিতার সাথে রয়েছে হাতে আঁকা ছবি। বইটির সম্পাদনা করেছেন আরেক জনপ্রিয় সাহিত্যিক ও পরিচালক এবং সুকুমার রায়ের সন্তান সত্যজিৎ রায়।
প্রথমভাগে ছড়া-কবিতাকে স্থান দেওয়া হয়েছে। পড়তে পড়তে দেখা পাবেন কুমড়োপটাশের সাথে। হয়তো কোনো এক অফিসের বড় বাবুর গোঁফ চুরিও দেখে ফেলতে পারেন। রামগরুড়ের ছানাকে চিনেন? না চিনলেও ক্ষতি নেই।
“রামগরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা,
হাসির কথা শুনলে বলে,
‘হাসব না-না, না-না’।”
খাই খাই করতে করতে সারা দুনিয়া খেয়ে ফেললেও যেন তার খিদে মিটেনা। তখন রায়সাহেব বলেন,
‘এত খেয়ে তবু যদি নাহি উঠে মনটা-
খাও তবে কচু পোড়া, খাও তবে ঘন্টা।’
দ্বিতীয় ভাগে হ য ব র ল ও পাগলা দাশুর কান্ডকারখানা সাজানো হয়েছে। গল্প কথকের স্কুলে পাগলা দাশুকে সবাই চিনে। তার আসল নাম দাশরথি। দাশুর মজার সব কান্ড পড়লে পাঠকের হাসি আসতে বাধ্য। সবজান্তা, নন্দলালের মন্দ কপাল গল্পগুলো ভালো ছিল। ভিন্ন স্বাদের একটি গল্প হলো ‘ভুল গল্প’। এখানে লেখক গল্প লিখে নিজেই আবার সেই গল্পের ভুলকে চিহ্নিত করে রসবোধের পরিচয় দিয়েছেন। দানের হিসাব গল্পে ভিখারির অনুরোধ অনুযায়ী প্রথম দিনে এক পয়সা ও ধারাবাহিকভাবে দ্বিগুণ ভিক্ষা নিয়ে একমাসেই রাজভান্ডার ফতুর হয়ে যায়।
হাইস্কুলে আমরা প্রায় সবাইই সুকুমার রায়ের বিখ্যাত নাটক অবাক জলপান পড়েছি। অবশ্য এখন পঞ্চম শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেই হাস্যরসাত্মক নাটকটিও এই বইতে পাবেন। এখনো ওই জায়গাটুকু পড়লে হাসি পায়,
” পথিক- মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?
ঝুড়িওয়ালা- জলপাই? জলপাই এখন কোথায় পাবেন? এ ত জলপাইয়ের সময় নয়। কাঁচা আম চান দিতে পারি-”
ছড়া-গল্প-নাটক পড়ে ত অনেক হাসলেন। এখন একটু জ্ঞান আহরণ করা যাক। কলম্বসের সাথে আমেরিকা আবিষ্কার, জোয়ান অব আর্কের সাথে ফরাসি বিদ্রোহ, সক্রেটিস, আলফ্রেড নোবেলের ডিনামাইট আবিষ্কার, গ্যালিলিওর সাথে মহাকাশে ভ্রমণ কিংবা ডারউইনের সাথে বিগল জাহাজের ভ্রমণসঙ্গীও হতে পারবেন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী পড়ার পর পৃথিবীর অদ্ভুত সব প্রাণীদের সাথেও পরিচয় হয়ে যাবে। অদ্ভুত প্রাণী সম্পর্কে ত অনেক জানা গেল, এখন বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন আবিষ্কারের সাথে পরিচিত হয়ে জ্ঞানের দুয়ার আরো প্রশস্ত করতেও পারবেন। সর্বশেষ গানের স্বরলিপি দেওয়া আছে, কৌতূহলী পাঠক না হয় একটু গানের রেওয়াজ করে নিতে পারবেন।
বইটিতে এত লেখা যে সবগুলো নিয়ে লিখতে গিলে আস্ত একটা বই লেখা হয়ে যাবে। সবগুলো রচনাই দারুণ। হাস্যরসাত্মক রচনার পরিমাণ বেশি, সাথে শিক্ষনীয় অনেক রচনাও রয়েছে। শিশুসাহিত্য হলেও প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকও পড়তে পারবে, সেক্ষেত্রে পড়ার সময় শৈশবের কথাই মনে করিয়ে দিবে। বিবিধ রচনায় অদ্ভুত প্রাণী বা বিভিন্ন আবিষ্কারের রচনা পড়ার পর মনে হতে পারে, আরে এসব ত জানিই! কিন্তু রচনাগুলো আরো একশো বছর আগে রচিত, তাই তৎকালীন সময়ে এই লেখাগুলোই ছিল পৃথিবী সম্পর্কে জানার মাধ্যম। কৈশোরকালের স্মৃতি রোমন্থনের পাশাপাশি সেই কৈশোরে ফিরে যাওয়ার অনুভূতি পেতে বইটি পড়তে পারেন।
Leave a comment