ময়মনসিংহ শহর সরগরম! শানকিপাড়ার পরিত্যক্ত পুকুরের তলায় একটি পুরোনো কাদামাখা গাড়ি পাওয়া গেছে, ড্রাইভিং সিটে বসে আছে হলদে কঙ্কাল।
ঘটনাটা ধামাচাপা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল এলাকার প্রভাবশালী কন্ট্রাক্টর সাঈদ আলীর। সুবিধা হলো না, ইন্সপেক্টর আহমেদ বাশারের জন্য। ময়মনসিংহ থানার ওসি আহসান মল্লিক কেসটা সোপর্দ করেছে বাশারের হাতে। সাথে গছিয়ে দিয়েছে বাপের বয়সী রমিজ দারোগা আর সদ্য গোঁফ গজানো আব্দুল্লাহকে। এদের নিয়েই তদন্তে নেমে পড়লো বাশার।
রহস্য জটিল হয়ে উঠলো ক্রমশ। গাড়িটা যে সময়ের হতে পারে, তখনকার সব দলিল – কাগজপত্র হাওয়া হয়ে গেছে। এদিকে বাশারকে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে রহস্যময় সাদা গাড়ি। ঘটনাক্রমে বাশারের সাথে জড়িয়ে পড়লো সাংবাদিক জয়া সরকার ও আর্কিওলজিস্ট রিফাত মজুমদার। জানতে পারলো রহস্যভেদ করতে হলে উন্মোচন করতে হবে দু’শো বছর আগের অন্ধকার অতীতের।
এই ময়মনসিংহেরই মুক্তাগাছার জমিদার রাজা সূর্যকান্ত আচার্য এর কাছে এসেছিল ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি দল। রাজার সঙ্গে দেখা করে সরকারের জন্য উপঢৌকন নিয়ে ফেরার পথে, রহস্যজনকভাবে উধাও হয় যায় সৈন্যদলটি। কি হলো তাদের – খোঁজ করতে পাঠানো হলো ক্যাপ্টেন ম্যাকফিকে, সাথে তার দুই বিশ্বস্ত অনুচর মহাবীর সিং ও লিউক জোনাথন।
কাজটা সহজ নয়। একে তো ব্রিটিশদের উপস্থিতি তেমন ভালো চোখে দেখে না স্থানীয়রা, তার ওপর ছয়জনের দলটি যেন বাতাসে উবে গেছে, এমনকি ঘোড়াগুলোও গায়েব। ম্যাকফি জানতে পারলো এক ভয়ংকর কিন্তু সুশৃঙ্খল ডাকাত দলের কথা। জোড়া কালীর উপাসক তারা, স্থানীয় লোকেরা চেনে এক নামে – ‘ঠগী’!
কথিত আছে পারস্যের রাজা জেরেক্সিসের সৈন্যদলের একাংশ ছিল এশীয়, তারা চামড়ার ফালি দিয়ে শ্বাসরোধ করে মানুষ খুন করতে পারদর্শী ছিল। পারস্যের যুদ্ধ শেষ হলে সেই দলটি চলে আসে ভারতবর্ষে। গোড়াপত্তন করে ভয়ংকর ঠগী বাহিনীর। পঞ্চাশ জনের বড় দল নিয়ে পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায় তারা। সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ী ও তীর্থযাত্রীদের দলের সাথে ভীড়ে যায়। কাপড়ের ফাঁস পেঁচিয়ে খুন করে লুটে নেয় সর্বস্ব।
গুপ্ত এই দলটির খোঁজে অনেক বছর ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কর্নেল উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান। কিন্তু পর্যাপ্ত কোনো প্রমাণ না থাকায়, ব্রিটিশ সরকার তার কথা শুনতে নারাজ।একলাই ঠগীদের নির্মূল করার শপথ নিল হেনরি স্লিম্যান।
উনিশ শতকের কর্নেল স্লিম্যান, ক্যাপ্টেন ম্যাকফি ও একবিংশ শতাব্দীর ইন্সপেক্টর বাশারের তদন্ত গেঁথে গেল এক সুতোয়।
‘সপ্তরিপু’ উপন্যাসে ব্রিটিশ আমলের ম্যাকফি ও বর্তমান সময়ের বাশারের গল্প চলেছে সমান্তরালে। দুটি ভিন্ন সময়ের টানটান কাহিনী বর্ণনার সময়ে, লেখক দক্ষতার সাথে পরিস্থিতিতে সামঞ্জস্য রেখেছেন। বাশার যখন থানায় খুঁজছে পুরনো ফাইল, ম্যাকফি হাটে সন্ধান করছে কোম্পানির ঘোড়ার। একটি অধ্যায় শেষ হয়েছে যে বাক্য দিয়ে, পরের অধ্যায় শুরু হয়েছে একইভাবে। শেষ অবধি এগিয়ে নিয়ে লেখক নিপুনতার সাথে দুটি সময়ের গল্পকে একসাথে জুড়ে দিয়েছেন।
চরিত্রগুলোর মধ্যেও একধরনের মিল পাওয়া যায়। বর্তমান সময়ের নায়ক বাশার তার ভুলের কারণে চাকরিতে ডিমোশন পেয়ে ময়মনসিংহ সদর থানায় এসে যোগ দেয়। তার অধীনে কাজ করে দুজন, রমিজ ও আব্দুল্লাহ। অন্যদিকে ম্যাকফিকেও মাদ্রাজ থেকে ব্রিটিশ সরকার একরকম নির্বাসন দেয় ভারতীয়দের পক্ষ নিয়ে কাজ করার জন্য, ময়মনসিংহে সে হাজির হয় দুই অনুচর নিয়ে।
উপন্যাসের চরিত্রের গঠনে লেখক কোনো ছাড় দেননি। তাই ভুঁড়িওয়ালা রমিজ, আঞ্চলিক মেশানো শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা আব্দুল্লাহ, ফরেনসিক ল্যাবের টমি পোদ্দার, জমিদারের সহিস ডুম্বুর আলী, ডংরু মহারাজ, জোহরা – প্রতিটি চরিত্রের বৈচিত্র্য পাঠককে আলাদা স্বাদ দিবে।
পুরো গল্পটি এগিয়ে গেছে ময়মনসিংহ শহরকে কেন্দ্র করে। স্থানীয় চরিত্ররাও অনেকে কথা বলেছে ময়মনসিংহের ভাষায়। যেসব পাঠক এই শহরের সাথে কোনোভাবে পরিচিত, তাদের কাছে ভালো লাগবে বইয়ের বর্ণিত শহরের অলিগলি, ব্রহ্মপুত্র নদী, শশীলজ, মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ির উল্লেখ। দড়ির খেলা, অস্ত্র আর পশুর হাটের বর্ণনায় প্রাচীন ভারতবর্ষের চিত্রায়ণও লেখক করেছেন চিত্তাকর্ষকভাবে।
বইটির নামকরণও প্রাসঙ্গিক। মানুষের ষড়রিপুর কথা তো সকলেই জানে, এর বাইরে সপ্তম একটি রিপু রয়েছে – আসক্তি। অতিরিক্ত ভক্তির প্রতি অন্ধের মতো আসক্তিই হলো সপ্তরিপু, যাতে আক্রান্ত ছিল ঠগীরা। কালীর সাধনায় উন্মত্ত হয়ে, ঠগী ধর্ম বানিয়ে নির্বিচারে মানুষকে বীভৎস ভাবে হত্যা করতো তারা। ঠগীদের ইতিহাস লেখক গল্পে ভেঙে ভেঙে এমনভাবে এনেছেন যে, বিস্তৃত ইতিহাসও আরোপিত মনে হয়নি।
দারুন থ্রিলারটিতে খারাপ লাগার মতো একটিই দিক ছিলো, অতিরিক্ত ছাপার ভুল। প্রুফরিডিং এর ক্ষেত্রে বাতিঘর প্রকাশনীর চরম অনিহা যথারীতি ফুটে উঠছিলো এই বইটিতেও। বাদবাকি বইয়ের বাঁধাই ও প্রচ্ছদ, সবই সন্তোষজনক।
প্রায় চারশো পৃষ্ঠার ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাসটি জটিল প্লট, পাশাপাশি প্রবাহিত দুটি কাহিনী ও একের পর এক চমকের কারনে পাঠককে পাতায় একেবারে আটকে থাকতে বাধ্য করবে নিঃসন্দেহে।
বইঃ সপ্তরিপু
লেখকঃ রবিন জামান খান
প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
প্রকাশনায়ঃ বাতিঘর প্রকাশনী
প্রচ্ছদঃ ডিলান
পৃষ্ঠাঃ ৪২৯
মুদ্রিত মূল্যঃ ৪৫০ টাকা
ছবিঋণ: কাজি হাসান জামিল
Leave a comment