“লাল গোলাপ”
ডায়েরী লেখার অভ্যাসটা আমার অনেক আগে থেকেই। সারাদিন কেটে যাওয়ার পর, ক্লান্ত শরীরকে একটু শান্তি দিতে ডায়েরীর প্রয়োজনীয়তা অনেক। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের “ক” বিভাগের ছাত্রী। দেশে তখন অরাজকতা বিরাজ করছে। কাল হয়তো কিছু একটা ঘটবে। সেইটা বড়ো কোনো বিষয় নয়। সমস্যাটা হচ্ছে তরুকে নিয়ে। সে তো রক্তগরম প্রকৃতির ছেলে। কী ছেড়ে কী করে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। কাল যদি সত্যিই মারামারি, আন্দোলন কিংবা গ্যাঞ্জাম লাগে, তাহলে আর কেউ যাক না যাক, তরুকে সেই ভীড়ের মাঝে একশ ভাগ পাওয়া যাবে। নাহ্ আজ আর লিখতে ইচ্ছে করছে না। মনটা কেমন জানি করছে। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম। ভাবছিলাম তরুকে নিয়ে। একটা ছেলে কীভাবে এতো চমৎকার হতে পারে!
তরু আর আমি একসাথেই পড়ি। আমি নিজেকে তার অংশ হিসেবে মনে করি। সে তরু, আমি লতা। নামের কী মিল! সে আমাকে পছন্দ করে, আমিও তরুকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু আমার ভালোবাসাটা প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে না। মনে খুব ভয় হয়। তরুকে সব বলে দিলে, যদি আমাকে পাওয়ার বাসনা তার কমে যায়, আমি তো তখন বেচে থেকেও বাচবো না। তরু আমায় কতবার বুঝিয়েছে, ইঙ্গিত দিয়েছে, এমনকি সেদিন তো সে মুখের সামনে এসে বলে গেলো, “লতা, আমি তোকে ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি বুঝলি! কেনো ভালোবাসি জানি না, কিন্তু অনেক ভালোবাসি তোকে। এখন বল তুই আমাকে ভালোবাসবি কিনা”, আমি উত্তরে বললাম, “ ভালোবাসি না, কী করবি?” সে কিছুক্ষন চুপ করে ছিলো, পরে বললো, “বেশ, ভালোবেসে কী করবি, তোর কিছুই করতে হবে না, আমি ভালোবেসেই যাবো, তোর বাসতে হবে না বুঝলি!” কোনো জবাব না দিয়ে মুখটা রাগী বানিয়ে অন্য পথে পাড়ি দেই। মনে মনে তখন খুব আনন্দ হচ্ছিলো, ইচ্ছে হচ্ছিলো, পাগলটাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলি, “হ্যাঁ রে পাগল, আমিও তোকে খুব খুব খুব ভালোবাসি”। কিন্তু ওই যে মনের ভেতরে যে ভয়টা গেথে আছে।
আমার ডায়েরীটা তরু খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে। তরু পড়ে বলেই ডায়েরী লেখার অভ্যাসটা আরোও তীব্র হয়েছে। কিন্তু গত এক সপ্তাহ্ যাবৎ সে অনেক ব্যস্ত। এই আন্দোলন, সেই মিটিং, এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানোর কারণে তাকে এখন আর খুজে পাওয়া যায় না। আমি বাসায় আছি প্রায় এক মাস হয়ে গেলো, তবে তরু আমার সাথে রোজ দেখা করতে আসে। সারাদিনে দেখা না হলে রাতে তাকে আমার বাসার নিচে এসে জোরে চিৎকার করতে দেখা যেতো। “লতা, কই তুই, আমার সামনে দেখা দে”। আমি খুশিতে লাফাতে থাকি, তারপর বারান্দায় গিয়ে বলি,
– বেয়াদ্দব, লজ্জা-শরম নেই বুঝি? এতো রাত্রে মেয়েদের হোস্টেলের সামনে এসে এভাবে ঘেউ ঘেউ করিস, কবে যে মেয়েদের হাতে গণপিটুনি খাবি, আমি সেই দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় আছি।
– এইটা তোর মুখের বুলি হয়ে গেছে? মানে আমি যখনই আসি, মুখস্থ করে রাখা এই কথাটা বলে ফেলিস। নাহ্, জীবনে প্রেমও করতে শিখলি না। প্রেম না করতে পারলেও, নাটক করতে শেখ! মাঝেমধ্যে নাটকের মাঝেও শান্তি খুজে পাওয়া যায়।
– আমার কোনো প্রেমও নেই, আমি নাটকও করতে পারি না। যা দূর হ।
– হুম তা তো যাবোই, রাতে আর জাগিস না, খেয়ে নিস, আর কালকে কিন্তু ডায়েরীটা পড়বো, সুন্দর করে লিখিস।
– পাইম না।
– তুই ঢং করতে থাক, আমি যাই।
– সাবধানে যাস।
কিন্ত আজ তরু আসছে না, মনের ভয়টা আরোও বেড়ে গেলো। কই কই যে থাকে এই ছেলেটা। এতো করে বোঝাই, কী দরকার এসব করে! কতো মানুষই তো আছে, তুই না হয় বাড়িতেই থাক। তার জবাব হয় এমন, “আমি আমার মা’কে পাই নি, কিন্তু মায়ের মুখের ভাষাকে কেড়ে নিতে দেবো না”। তখন আমার আর বলার কিছু থাকে না। ছেলেটা মা হারা, মায়ের প্রতি আলাদা এক আবেগ কাজ করাটা স্বাভাবিক, কিন্তু তরুর কিছু হলে আমি তো নিজেকে সামলে রাখতে পারবো না। কিন্তু তরু আর এলো না।
অস্থির মনটাকে বিছানা থেকে তুলে স্টাডি টেবিলের সামনে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর করলাম। কাল তরুকে আমার এক সপ্তাহের লেখা পড়াবো। আর আজকে যা যা লিখবো, তা দিয়েই তরুকে বুঝিয়ে দেবো, কতটা ভালোবাসি তাকে। তার জন্য অপেক্ষা করছি সেই ১লা ফাল্গুন থেকে, তাকে সব বলবো বলবো বলে, বলার সুযোগটা হয় নি। কাল থেকে আমার অনুভূতির ডায়েরীটা চিরকালের জন্য তার নামে লিখিয়ে নেবো। আর সাথে করে তার পছন্দের একটা লাল-গোলাপ নিয়ে যাবো। বাসার ছাদে লাল-গোলাপের অনেকগুলো গাছ আছে। সেখান থেকে একতা ফুল বিকেলেই ছিড়ে নিয়ে এসেছিলাম, আর পানিতে ভিজিয়ে রেখেছিলাম। তরুর ফুল অনেক পছন্দের। রাগী মেজাজের মানুষ হলেও, রাগটা তার বাহ্যিক চরিত্র। ওর ভেতরটা কুসুমের মতোই নরম। ছেলেটা বেশ আবেগী। তবে আবেগটা সে কেবল আমার সামনেই প্রকাশ করে। বাকিরা তার বাহ্যিক রূপটাই দেখে।
কল্পনায় তাকে সামনে নিয়ে কতগুলো বাণী রচণা করলাম, ইচ্ছে করছিলো, রাতের এই অন্ধকারের মাঝে দিয়ে হেটে তাকে নিয়ে আলোকিত জগতের সন্ধানে চলে যাই। কী যে ভাবছি আমি! লিখতে লিখতে আমি টেবিলের উপরেই ঘুমিয়ে যাই। আর সেই ঘুম ভাঙ্গে ঠিক দুপুর ১২টায়। চোখের কত রাজ্যের ঘুম যে ছিলো কে জানে! অবশ্য ঘরে বসে থাকতে থাকতে অলস হয়ে গেছি। ঘুম থেকে উঠে মুখ হাত ধুয়ে নিলাম। ভাবলা একটু ছাদে গিয়ে ঘুরে আসবো। বাহিরে যাওয়ার সময় দরজার সামনে একটা কাগজ পড়ে থাকতে দেখলাম। কী এটা! চিঠি!! আমি অবাক হলাম। চিঠিটা হাতে নিয়ে খুললাম। তরু লিখিছে! চিঠিটা পরে আমি শিউরে উঠলাম। আমার পায়ে যেনো মাটি নেই। মাথায় আমার আকাশ ভেঙ্গে পড়লো!
“লতা, জানি না কাল তোমার বাসার নিচে এসে ডাকতে পারবো কিনা, দেশের পরিস্থিতি ভালো নেই। কাল হয়তো একটা ঝামেলা হবে। বেচে ফিরলে কাল আসবো। আরেকটা কথা! আমি তোমায় ভালোবাসি। ভালো থেকো লতা।
ইতি,
তরু”
চিঠিটা পড়া মাত্র দেরি না করে রেডিওটা চালালাম।
“ঢাকা মেডিকেলের সামনে আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশের হামলা, নিহতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ইতিমধ্যে ঢাকা মেডিকেলের জরুরী বিভাগ পূর্ণ হয়ে গেছে বলে জানা গেছে”।
—
ডায়েরী লেখা পুরোপুরি বন্ধ করে দিলাম। ডায়েরী-টা যাকে দেবো বলে লিখছিলাম, সে তো কতো বছর যাবৎ, আমার খোজ নেয় নি। বাসার নিচে আর কোনোদিন একটা ডাক দেয় নি। তার মায়াভরা সেই চোখ দুটি কতদিন ধরে দেখি নি। কতোদিন হয়ে গেলো, তাকে আমার গান শোনাই নি। আর কতোদিন হয়ে গেলো, তার কন্ঠ শুনি নি। তার প্রতি আমার অনেক অভিমান। কতোটা অভাগা আমি, তার লাশটুকু দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নি। সেদিনের খবরটা শোনা মাত্র, আমার দুনয়ন অশ্রুশিক্ত হয়েছিলো, আমি বাসা থেকে বেরিয়ে মেডিকেলের সামনে চলে আসি। সবখানে খোজ করি, কিন্তু তরুকে আর পাই নি। অঝোর ধারায় কেদেছিলাম সেদিন। তরু তো আমার কান্না সইতে পারতো না, কই! তরু তো এলো না। আর এলোই না, চিরতরে বিদায় নিলো আমার কাছ থেকে। বারবার তরুকে ডাকছিলাম, সে যেনো শেষবারের মতো আমার সামনে আসে, তাকে একটাবার জড়িয়ে ধরতে চাই। কিন্তু আমার এই চাওয়াটা অপূর্ণ রয়ে গেলো। অসমাপ্ত ডায়েরীটা যেনো আমার অসমাপ্ত ভালোবাসা। তরুকে আর জানানো হলো না, কতোটা ভালোবাসি তাকে। তার আগেই সে আমায় ছেড়ে বহুদূর চলে গেছে। তরুর জন্য আনা সেই লাল-গোলাপটা আজও আমার ডায়েরীর ভেতরে আছে। আর তার লিখে যাওয়া সেই চিঠিখানা। যেনো তরুকে সেই ডায়েরীর ভেতরে রেখে দিয়েছি। তাকে রেখেছি আমার বুকের মাঝে, অনেক গভীরে, সহস্র লাল-গোলাপের মাঝে।
লেখনীতে,
তাহমিদ আহমেদ
ভলেন্টিয়ার কনটেন্ট রাইটার
রাইটার্স ক্লাব বিডি
Leave a comment