মুহিব। স্টেট ইউনিভার্সিটির ম্যাকানিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র সে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যকার আলো ও অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে ছাত্রজীবন শুরু করা অন্য দশজনের মতই এক ছেলে। বন্ধুরা হলেন শামীম, ইলোরা এবং লিটু।
কালিগোলা অন্ধকারে সিগ্রেট ফুঁকে একটু রিল্যাক্স করতে গিয়ে আর সাধারণ দশজন ছাত্রের মত থাকা হয়ে উঠলো না মুহিবের। সংগঠিত হল এক ভয়ানক হত্যাকান্ড। একটু দূরে থেকেও কিছু করতে না পারা মুহিব ঠিকই বুঝতে পারলো খুনি কারা।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্টেট ইউনিভার্সিটি একটু বেশি রক্ষণশীল এবং বদ্ধ পরিবেশের। এখানে একদিকে যেমন আছে দলীয় ক্যাডারদের অত্যাচার আবার অন্যদিকে আছে শিক্ষকদের লাগামহীন অস্বচ্ছতা। জবাবদিহীতার অভাবে অপছন্দের ছাত্রছাত্রিদের ক্যারিয়ার লাটে তুলতে তাদের বিবেকে কোন নাড়াচাড়া হয় না।
এর মধ্যে ক্যালটেক ইউনিভার্সিটি থেকে হাজির হলেন এক রহস্যময় শিক্ষক। বাম হাত কনুইয়ের নিচ থেকে কাটা রবিন জামান খানের উপস্থিতিতে পাল্টে যেতে লাগলো স্টেট ইউনিভার্সিটির বাতাসের ঢেউ। তবে হাকারবিন স্যার যেন সাঁতরাচ্ছেন ঠিক স্রোতের বিপরীতে। যেখানে স্রোত অনেক তীব্র।
তদন্তে নেমে পড়লো মুহিব এবং তাঁর বন্ধুরা। কিন্তু অত্যন্ত ভয়ানক ক্যাডারদের সামনে তাঁরা তো ধূলিকণার চেয়েও ক্ষুদ্র। লেখালেখির প্রতি তীব্র প্যাশনে ভুগা মুহিব ভুগতে থাকে নিদারুন অপরাধবোধে। যে অপরাধবোধের কারণে সে হয়তো পরিণত হতে পারে বিবাদমান কোল্ড ওয়ারে থাকা একই ছাত্র সঙ্ঘের দুই গ্রুপের কোন একটির গুটিতে।
উগ্রপন্থি কমিউনিষ্ট গ্রুপেরই বা কি স্বার্থ আছে এইসবে? দেশজুড়ে আতংকের আরেক নাম ‘অনুশীলন গ্রুপ’ এর হাইলি ট্রেইন্ড কেউ কেউ জড়িয়ে পড়েন এই নৈরাজ্যে।
সান জু বলেছিলেন, “নৈরাজ্যের মাঝেই সুযোগ নিহিত।” তবে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার কারা করতে পারবেন শেষ পর্যন্ত? পরিস্থিতি কত ড্যাসপারেট হয়ে গেলে একজন সাধারণ ছাত্রের হাতে উঠে আসতে পারে অস্ত্র?
কিশোর পাশা ইমন সবসময় কয়েক স্তরে গল্প বলে থাকেন। এই উপন্যাসে স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদের অমানবিক আচরণ যেমন আছে তেমনি আছে কিছু শিক্ষকের সাধারণ ছাত্রের প্রতি নির্ভেজাল ভালোবাসা। ছাত্ররাজনীতির ভয়াল অন্ধকার রূপ আছে একদিকে আবার অপরদিকে আছে অপেক্ষাকৃত ভালো ছাত্রনেতাদের উপস্থিতি, তবে তাদের হাত যেন বাঁধা। উদীয়মান লেখক মুহিবের কাছ থেকে লেখালেখি সংক্রান্ত নলেজ শেয়ারিং কিছুটা পাওয়া যায় এই স্টোরিতে। বদ্ধ সমাজের ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় নেই কেপির এই নভেলে। কোদালকে জিলেট মাক থ্রি টার্বো বলতে চান নি লেখক।
আবার দরিদ্রঘরের সন্তান লিটুর প্রচন্ড স্ট্রাগলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলোরা বা তূর্ণার মত মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা এবং সেই বিষয়ে প্রায় সকলের উদাসীনতা যেকোন পাঠকের মনে বিপন্নতা সৃষ্টি করতে পারে। বন্ধুকে বাঁচানোর জন্য ফান্ডের জোগার, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার নামে ফালতুমি এবং নিরপরাধ ছাত্রছাত্রিদের সাথে চরম প্রহসন ছত্রে ছত্রে ছুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। কেপিকে আজ পর্যন্ত খারাপ লিখতে দেখলাম না। নাকি তাঁর খারাপ কোন লিখা আমি এখনো পড়িনি? বাংলাদেশের খুব সম্ভবত সবচেয়ে পরিশ্রমী এবং জেদি লেখক কিশোর পাশা ইমন। থ্রিলারের শুরুতেই খুনির পরিচয় প্রায় জেনে যাওয়া সত্ত্বেও কেন একজন পাঠক এই উপন্যাস পড়ে যাবেন? শুধুমাত্র কেপির গল্পকথনের উপর দানবীয় দক্ষতার কারণে।
বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো একধরণের শক্তিকেন্দ্রই। যেখানে শক্তিমানেরা তাদের মাসল ফ্ল্যাক্স করে থাকেন। তবে অনেক সময় তাঁরা হয়তো ভুলে যান যে আপাত সাধারণ দেখতে ছাত্রটির মাঝেও থাকতে পারে তীব্র আগুনের গুদাম। যে অগ্নি হয়তো পাল্টে দিতে পারে অনেককিছুই। আবার হয়তো আনতে পারে ছোটখাট কোন পরিবর্তন। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের বারংবার হেরে যাওয়াটা মেনে নিতে নিতে একজন সচেতন পাঠক হয়তো নিজেকে ভাবতে পারেন বিপন্ন।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
যে হীরকখন্ডে ঘুমিয়ে কুকুরদল
লেখক : কিশোর পাশা ইমন
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৮
প্রকাশনা : বাতিঘর প্রকাশনী
প্রচ্ছদ : ডিলান
জনরা : থ্রিলার, সামাজিক উপন্যাস
রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ
Leave a comment