হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের সম্ভবত কঙ্কালের প্রতি ভালোলাগা ছিলো। তাঁর অনেকগুলো লেখাতেই এই কঙ্কাল ভূত এসেছে। এবং যথারীতি সে গল্পগুলো নীরস হয়ে গেছে, তখনকার যুগে কঙ্কালের হাড়গোড় দেখে আর নাকি সুর শুনে মানুষ ভিরমি খেলেও বর্তমান সাইকোলজিকাল হররের যুগে এসব অচল।
তবে তাঁর সবগুলো কাহিনী শ্যালো সেটা আমি বলছিনা। এই কঙ্কাল বাদ দিলে হরিনারায়ণের বাদবাকি ভৌতিক লেখাগুলো বেশ ভালো। কিছু কিছু একদম দুর্দান্ত।
তাঁর লেখার সবচে বড় দিক হলো ভয়ের পরিবেশ তৈরী করা। বেশিরভাগ লেখার পটভূমিতেই রয়েছে পোড়োবাড়ি, পুরনো জমিদার বাড়ি, অন্ধকার রাস্তা, পথ হারানো পথিক এবং বিদেশি অজানা অচেনা প্রান্তর। বহু জায়গা ঘুরেছেন বলেই হয়তো বারবার লেখাকে নিয়ে গেছেন বাংলার বাইরে- এতে বৈচিত্র্যও বেড়েছে। বিশেষ করে নবাবী আমলে বেড়ে ওঠা লখনৌ শহর তাঁর বেশ কয়েকটি লেখার কেন্দ্রবিন্দু, এছাড়াও নবাবী আমলের আদবকায়দা, সংস্কৃতিও এসেছে তাঁর লেখায়। যার উদাহরণ – অবিশ্বাস্য, জনাব মঞ্জিল, রাত্রি নিশীথে, রাতের প্রহরী ইত্যাদি।
গ্রামবাংলার প্রকৃতি, গাছপালা, ছায়াঘেরা পুকুর, ঘন জঙ্গল, কচুরিপানা শ্যাওলা টুপটাপ বৃষ্টি আর ঝিঁঝির ডাক এসব ফুটিয়ে তুলতে হরিনারায়ণের জুড়ি নেই। তাঁর লেখা মৃত্যুর পরে, পাঁচ মুন্ডীর আসর, কুপার সাহেবের বাংলো, ভূতচরিত, বনকুঠির রহস্য আর সবচে উল্লেখযোগ্য লাল নিশানা গল্পে এই প্রকৃতিকে এনেছেন লেখক। বার্মাতে জীবনের প্রথম দুই যুগ কাটালেও বার্মা নিয়ে হরর কম, কেবল ফাঁসির আসামী ছাড়া। সে গল্পটিও বেশ ভালো।
তিনটি জিনিস তাঁর গল্পে কমন পেয়েছি –
১. রাতের আঁধারে পথ হারানো পথিক
২. শহর থেকে দূরে রুরাল এরিয়ায়/বাংলার বাইরে অন্য প্রদেশে কোনো পরিত্যক্ত কুটির/বাড়ি/বাংলো
৩. পথ হারিয়ে/বন্ধুর আমন্ত্রণে লেখকের সে বাড়িতে রাত কাটানো ও ভৌতিক অভিজ্ঞতা।
লেখক এই তিনটির বাইরে বেরোতে পারেননি তেমন। পাঁচ মুন্ডীর আসর, অমরধাম, আমরা আছি, জনাব মঞ্জিল, কুপার সাহেবের বাংলো, গভীর রাতের কান্না, রাত্রি নিশীথে, ভুতুড়ে রাত, মৃত্যুর পরে, রাতের প্রহরী, বনকুঠির রহস্য ও বেনেটির জঙ্গলে ইত্যাদি গল্প এরকম আইডিয়া দিয়ে লিখা।
এবার আসি গল্পে।
আরণ্যক গল্পটি এক ভৌতিক চিতা শিকারের। বেশ ব্যতিক্রমী। বেঘো ভূতের কথা পড়েছিলাম দেবীপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায়ের লেখায়। এর বাইরে শিকার ও হররের কম্বিনেশন চোখে পড়েনি।
ভুতুড়ে কান্ড আমার পার্সোনাল ফেভারিট। গল্পটি আগেও পড়া ছিল। এক কিশোর মামাবাড়িতে গিয়ে ভূতের আছর পাওয়া আত্নীয়ের মুখোমুখি হয়- সেটা নিয়েই কাহিনী। একদম গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে সহজ ভাষায় লেখা। কোনো সাইকোলজিকাল কিছু না। তবুও দুর্দান্ত।
লাল নিশানা আমার পড়া দি বেস্ট স্টোরি। এত সুন্দর করে হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এক বন্ধ্যা নারীর আত্নকথন, তার অন্তর্জ্বালা, করুণ মৃত্যুর কথা তুলে এনেছেন – সেই সাথে বাদলের দিনে সন্ধ্যা নামা ছায়াঘেরা আঁধার এক গ্রাম্য কুটির – সব মিলিয়ে একই সাথে গল্পটি মনকে বেদনার্ত ও আতঙ্কিত করে দেয়। ব্রাভো দেয়া ছাড়া গতি নেই।
রূপে সে কুরূপাও প্রায় সেম স্টোরি। বন্ধ্যার পরিবর্তে এখানে মূল অভাগী এক কালো মেয়ে, রঙের জন্য যার বিয়ে হয়নি। এই গল্পটিও মন খারাপ করা।
সুরের মায়া – লেখাটি অনেকটা মঞ্জিল সেন ধাঁচের। এক অভিশপ্ত বস্তু, তাকে ঘিরে নানা হরর এক্সপেরিয়েন্স। এক্ষেত্রে বস্তুটি একটি ব্রিটিশ পিয়ানো। খুব সাজানো গল্পটি।
ভূত নেই? – কলকাতার শহরতলীর এক নতুন ভাড়া হওয়া বাসা নিয়ে, যে বাসায় ওঠা নবদম্পতি অদ্ভুত কিছু অভিজ্ঞতার শিকার হয়। একদম কমন কাহিনী, আগের ভাড়াটিয়াদের কেউ সুইসাইড করে, তার কুফল পরের ভাড়াটিয়ারা পায়। কিন্তু লেখা পড়ে বোর হবার সুযোগ নাই।
এছাড়া বানরের পাঞ্জা, কুপার সাহেবের বাংলো, পিছনের জানলা, পাঁচ মুন্ডীর আসর, রাত্রি নিশীথে, মৃত্যুর পরে, অবাস্তব – এগুলোও ভালো লেগেছে।
সামন্ত বাড়ি, রাত গভীর, বিনোদ ডাক্তার, বেনেটির জঙ্গলে – এসব গল্প নেহাতই বাজে লেগেছে। কিছু তো হররের বদলে কমেডি হয়ে বসে আছে। বলা যায় কঙ্কাল এসে সব শেষ করে দিয়েছে। দুটো গোয়েন্দা গল্প আছে (ভয় সমগ্রতে কেমনে ঢুকলো জানিনা) – গোয়েন্দা ও প্রেতাত্মা এবং অমানুষিক। মোটামুটি চলনসই।
“ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়”, প্রকাশক বুকফার্ম। গায়ের মূল্য আড়াইশো টাকা।
ব্যক্তিগত রেটিং – ৪/৫।
ব্যক্তিগত বেস্ট চয়েজ – লাল নিশানা।
হ্যাপি রিডিং।
Leave a comment