ব্লাড পেইন্টিং
©মারুফ হুসাইন।
✋এক নজরে ব্লাড পেইন্টিং পর্ব সমূহ💕
৭.
গোলাম মাওলা একাধিকবার সায়মাকে কল দিল। কিন্তু সায়মা কল রিসিভ করল না। তার রাগ প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চে যোগ দেয়ার প্রথম শর্তই হলো, অবসর বা ছুটি বলতে কিছু নেই৷ যখনি দরকার হবে হাজির হতে হবে৷ দুপুরে কাজ ছিল না, তাই ছুটি দেয়া হয়েছিল৷ কিন্তু এখন যখন দরকার সে ফোনই রিসিভ করছে না।
সে সায়মাকে রিচ করতে না পেরে রাফাতকে ফোন করল, ‘রাফাত! তুমি বাসায় পৌছে গেছ?’
‘জি স্যার!’
‘দ্রুত ফরেন্সিজ ল্যাবে চলে আসো! আর্জেন্ট!’
‘ঠিক আছে স্যার!’
গোলাম মাওলা ফোন রেখে ল্যাবের দায়িত্বরত জাবের চৌধুরিকে বলল, ‘জাবের সাহেব! এক কাজ করুন?’
‘কী?’
‘আজ সারাদিনে যারা ল্যাবে ঢুকেছে, সবাইকে ডেকে পাঠান!’
‘আজ সারা দিন যারা যারা ল্যাবে এসেছে, সবাইকে এখনি আসতে বলেন! বলবেন আর্জেন্ট!’ জাবের চৌধুরি তার এক সহকারিকে ডেকে বলল।
‘ওকে স্যার!’ বলে সহকারী চলে গেল।
‘জাবের সাহেব! পেইন্টিংটা চোখে চোখে রাখা দরকার ছিল। আপনি ভাবতেও পারছেন না, কত বড় ক্ষতিটা সামনে হতে যাচ্ছে।’
‘মানে?’
‘আমি ধারণা করছি, সুইসাইডগুলোর পিছনে এই পেইন্টিংটা বড় ভূমিকা পালন করছে।’
‘দুইটা সুইসাইড স্পটে এই পেইন্টিংটা দেখা গেছে৷ দুই স্পটের আলাদা পেইন্টিং নয়৷ একই পেইন্টিং।’
‘কিভাবে নিশ্চিত হলেন?’
‘দ্বিতীয় সুইসাইড স্পটে যখন দেখেছি, তখন প্রথম স্পটে গিয়ে দেখি পেইন্টিংটা নেই। উধাও। যেখানে ঐ ফ্ল্যাটের নিয়ন্ত্রণ আমাদের কাছে ছিল।’
‘আপনি সিউর এই একই পেইন্টিং দুইটা স্পটেই ছিল?’
‘হ্যাঁ, আমার কাছে এই পেইন্টিংটা খুবই রহস্যজনক লাগছে। এই পেইন্টিংটার দিকে তাকালে কেমন তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। মনে হয় পেইন্টিংটা কেমন আকৃষ্ট করছে। মস্তিষ্ক নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। মনে হয়, পেইন্টিংটা মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করছে’
‘গোলাম মাওলা সাহেব! আপনি কী বলছেন, বুঝতে পারতেসেন? এতো ভালো একজন গোয়েন্দার মুখ থেকে এসব কথা বের হচ্ছে! আমি ভাবতেও পারছি না। একটা পেইন্টিং কিভাবে কারো মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।’
ঠিক তখনি গোলাম মাওলার মোবাইল বেজে উঠে। সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে। ফারুকের কল, ‘স্যার! অফিস থেকে ফোন এসেছে। সামিয়ার হাজবেন্ড এসে বসে আছে। আমি অফিসের দিকে যাচ্ছি৷ আপনি কি আসবেন?’
‘যাও তুমি! আমি আসছি!’
মোবাইলটা কান থেকে নামিয়ে গোলাম মাওলা বলল, ‘জাবের সাহেব! আমার একটু অফিসে যেতে হবে। সবাই চলে আসলে আমাকে একটা কল দিবেন!’
‘ঠিক আছে।’
আধ ঘন্টার মধ্যে গোলাম মাওলা অফিসে পৌছে যায়। রাফাতকে ফোন করে ল্যাবে গিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে বলে দিয়েছে৷ তার আগেই ফারুক চলে এসেছে।
সে অফিসে ঢুকেই ফারুককে পেয়ে গেল। তার সামনে মধ্যবয়সী একটা লোক বসে আছে। গোলাম মাওলাকে দেখে ফারুক দাঁড়িয়ে গেল। তাকে অনুসরণ করে ঐ লোকটাও দাঁড়িয়েছে৷ ফারুক সালাম দিয়ে বলল, ‘স্যার! উনি সামিয়ার হাজব্যান্ড! আসার পথে উনার মোবাইল হারিয়ে গেছে। যার কারণে নাম্বার বন্ধ ছিল।’
লোকটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি জাফর খন্দকার!’
গোলাম মাওলা হাত মিলিতে একটা চেয়ার টেনে বসে জাফর খন্দকারকেও ইশারায় বসতে বলল।
‘ফারুক! চা আনতে বল!’
‘জাফর সাহেব! সামিয়ার সাথে আপনার শেষ কবে কথা হয়েছে?’
‘পরশু দিন রাতে!’
‘কী কথা হয়েছিল?’
‘তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়৷ সেদিন ওর বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত এগারোটা বেজে গিয়েছিল। সারা দিন তার কিভাবে কাটল, আমার কেমন কাটল, এইসব ক্যাজুয়াল কথা-বার্তা।’
‘এমন কোনো কিছু বলেছে, যেটা আপনার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে।’
‘না এমন কিছুই বলেনি। তবে…’ বলেই জাফর খন্দকার থামল।
‘তবে কী?’
‘সে সেদিন একটা পেইন্টিং কিনেছিল। যেটার কথা আমাকে খুব আগ্রহ নিয়ে বলেছে। তখন ব্যপারটা আমার কাছে অস্বাভাবিক না লাগলেও এখন লাগছে।’
‘কেন?’
‘কারণ এসব নিয়ে তার কখনোই কোনো আগ্রহ দেখিনি৷ কিন্তু সেদিন পেইন্টিংটা নিয়ে তার খুব আগ্রহ দেখা যাচ্ছিল।’
‘পেইন্টিংটা নিয়ে কী কী বলেছে?’
‘পেইন্টিংটার বর্ণনা করছিল। কিভাবে কত দাম দিয়ে কিনল এসব আরকি!’
‘কী কী বলেছে, কোথা থেকে কিনেছে সব কিছু এক্সাক্ট বলুন!’
‘আমার কাছে অহেতুক কথা-বার্তা মনে হয়েছে। আমি তেমনভাবে খেয়াল করিনি। তাই ঠিক মতো মনেও নেই। রাস্তায় কোনো এক লোক থেকে কিনেছে, হকার-টকার কারো কাছ থেকে হবে হয়তো। পেইন্টিংটা খুবই সুন্দর আবার অনেক দামীও নাকি! কিন্তু সে নামমাত্র মূল্যে কিনেছে৷…’ বলেই জাফর খন্দাকার থামল, ‘এই ব্যাপারে আমার আর তেমন কিছুই মনে নেই৷’
গোলাম মাওলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু একটা ভেবে বলল, ‘তার সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?’
‘হাজবেন্ড এবং ওয়াফের মধ্যে সম্পর্ক যেমন হয়।’
‘ঝগড়া হতো না?’
‘স্যার! হাজবেন্ড ওয়াইফের মধ্যে ঝগড়া হওয়াটা খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। আমাদের মধ্যেও হতো। অনেক ছোট-খাটো বিষয় নিয়েও ঝগড়া হতো, কথা কাটাকাটি হতো। আবার ঘুম থেকে উঠে দুজনই সেগুলা ভুলে যেতাম৷’ একটু থেমেই জাফর খন্দকার বলল, ‘আমরা দুজনই বাস্তববাদী মানুষ। দুই দুজনকে সম্মান করতাম, ভালোবাসতাম। কিন্তু কারো লাইফে কেউ ইন্টারফেয়ার করতাম না৷’
চা চলে এসেছে। গোলাম মাওলা নিজ একটা কাপ নিয়ে আরেকটা জাফর খন্দকারের দিকে এগিয়ে দিল, ‘আপনি আসার পর থেকে একবারও আপনার ওয়াইফের লাশ দেখতে চাননি। বিষয়টা আমার কাছে খুব অদ্ভুত লাগছে।’
‘আগেই বলেছি, আমি বাস্তববাদী মানুষ। প্রথমে তার এমন সুইসাইডের খবরটা শুনে ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠলেও নিজেকে সামলে নিয়েছি৷ এখন বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে লাভ নেই। যা বাস্তব তা মেনে নিতেই হবে।’
‘গোলাম মাওলা আর কিছু জিজ্ঞাসা করল না, ‘ঠিক আছে এখন আপনি আসতে পারেন। যাওয়ার আগে নতুন নাম্বারটা দিয়ে যাবেন। দরকার হলে আপনাকে ফোন দিব। আর কেসটা বন্ধ হওয়া অবধি কোথাও যাবেন না৷’
‘জি আচ্ছা।’ বলে জাফর খন্দকার চেয়ার থেকে ওঠে দাঁড়াল, ‘সামিয়ার লাশটা শেষকৃত্যের জন্য কবে পাওয়া যাবে?’
‘কাল আপনাকে ফোন দেয়া হবে।’
জাফর খন্দকার বেরিয়ে যেতেই গোলাম মাওলা ফারুককে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘লোকটা কী অদ্ভুত! স্ত্রী বাজেভাবে সুইসাইড করেছে, কিন্তু লোকটার কোনো ভাবান্তর নেই। একদম স্বাভাবিক। তোমার কী মনে ফারুক, সামিয়ার সুইসাইডের পিছনে এই লোকটার কোনো হাত আছে?’
‘বুঝতে পারছি না স্যার!’
৮.
গোলাম মাওলা অফিস থেকে বেরিয়ে ল্যাবের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়৷ রাফাত অনেক আগেই পৌছে গেছে। সে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করে দিয়েছে।
গোলাম মাওলা অফিসে ঢুকতেই রাফাত আর জাবের চৌধুরি এগিয়ে আসল।
‘স্যার! একটা বাজে খবর আছে?’ রাফাত আমতা আমতা করে বলল।
‘কী বাজে খবর?’
জাবের চৌধুরি তার এক সহকারীকে ডাক দেয়, ‘সব কিছু খুলে বলো!’
‘স্যার! দুপুরে লাঞ্চের সময় সবাই বাইরে চলে যায়। ল্যাবে আমি একাই ছিলাম। তখন বিদ্যুৎ চলে যায়। যার ফলে সিসিক্যামেরাগুলোও অফ হয়ে যায়। তার কিছুক্ষণ পরই সায়মা ম্যাম আসেন। কাজ-বাজ কতদূর এগিয়েছে জিজ্ঞাসা করে যেগুলোর রিপোর্ট রেডি হয়েছে, সেগুলার রিপোর্ট দেখতে চান। আমি রিপোর্টগুলো তার কাছে দিয়ে ওয়াশরুমে যাই। ওয়াশরুম থেকে ফিরে দেখি উনি চলে গেছেন। আমি আর এই নিয়ে মাথা ঘামাইনি। কাউলে বলিওনি।’
‘স্যার! এই বিল্ডিংয়ের অপজিটে মানে রাস্তার ওপাশে একটা বিল্ডিং আছে৷ যার ভিন্ন বৈদ্যুতিক লাইন। এখানে বিদ্যুৎ চলে গেলেও ওটাতে বিদ্যুৎ ছিল। তাই মনে হলো, এই বিল্ডিংয়ের প্রবেশ-বাহির ঐ বিল্ডিংয়ের সিসিক্যামেরায় আসার কথা। ওর কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ওখানে গিয়া আমি সিসিক্যামেরা চেক দেই।’ বলে রাফাত তার মোবাইল বের করে ফুটেজটা দেখায়। ল্যাব বিল্ডিং পর্যন্ত ফুটেজ অস্পষ্ট হলেও বুঝতে কষ্ট হয়নি যে সায়মা ল্যাবে খালি হাতে ঢুকলেও কিছু একটা নিয়ে ল্যাব থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আর সেটা যে পেইন্টিংটা-ই তা কারোই বুঝতে কষ্ট হয়নি।
গোলাম মাওলার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেল। সায়মা পেইন্টিংটা নিয়ে গেছে কেন তার বুঝে আসছে না। সে সায়মাকে ফোন করল। কিন্তু সায়মা ফোন ধরছে না।
সায়মা ফ্লোরে লেপ্টে বসে আছে। তার ঠিক দু হাত সামনেই পেইন্টিংটা রাখা৷ সে সম্মোহনী দৃষ্টিতে সেটার দিকে তাকিয়ে আছে। মোবাইল খাটের উপর রাখা। একের পর এক কল বেজেই চলছে। কিন্তু সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই৷ ঘন্টা তিনেক আগেও সে কী ভাবছিল না ভাবছিল, তার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে কী পরিকল্পনা করছিল, কিছুই তার মাথায় নেই। সে পেইন্টিংটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কী ভাবছে না ভাবছে সে নিজেও জানে না। পেইন্টিংটার সামনেই ব্লেডের প্যাকেটটা পড়ে আছে। যেটা স্বাভাবিকভাবে তার ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে থাকে। কখন ব্লেডের প্যাকেটটা বের করেছে সে নিজেও জানে না। পেইন্টিংটার দিমে তাকিয়ে থেকেই একটু একটু করে সে ব্লেডের প্যাকেটটার দিকে হাত নিয়ে যাচ্ছে৷
গোলাম মাওলা ঘড়ি দেখল। এগারোটার উপরে বাজে৷ এখন কী করা উচিৎ তার বুঝে আসছে না। সায়মাকে আবার ফোন দিল। কিন্তু সায়মা এবারও ফোন রিসিভ করল না। গোলাম মাওলা মোবাইলটা পকেটে রাখতে রাখতে বলল, ‘রাফাত! তুমি সায়মার বাসার ঠিকানা জানো তো?’
‘জি স্যার! এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। তাকে তার বাসায় পাবো কিনা কে জানে! আমাদের আর দেরী করা উচিৎ হবে না। জলদি চল!’
গোলাম মাওলা রাফাতকে নিয়ে সায়মার বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।
চলবে…..
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?