ব্র্যান্ডন স্যান্ডার্সন ও কজমেয়ার জগৎ
১.
ব্র্যান্ডন স্যান্ডার্সনের কজমেয়ার জগত নিয়ে লিখতে গিয়ে দেখি অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। তাই খন্ড খন্ড আকারে দেয়ার চেষ্টা করছি।
ব্র্যান্ডন স্যান্ডার্সনের লেখা নিয়ে যতই বলি না কেন, মনে হয় কিছুই বলা হলো না! বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় ফ্যান্টাসি লেখক তিনি। লিখেছেন মিস্টবর্ণ সিরিজ এব্ং স্টর্মলাইট আর্কাইভের মত আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পাওয়া বই, জিতেছেন হুগো এওয়ার্ড, হুইটনি এওয়ার্ড, গুডরীডস চয়েস এওয়ার্ড সহ আরো অনেকগুলি স্বনামধন্য সম্মাননা। তবে তাঁর ভাষ্যমতে সবচেয়ে সম্মানজনক হলো রবার্ট জর্ডানের এপিক ফ্যান্টাসি সিরিজ দ্য হুইল অব টাইমের শেষ উপন্যাসটি লেখার আমন্ত্রণ পাওয়া।
পরে এই সিরিজের প্রকাশক এব্ং স্যান্ডার্সন মিলে সিদ্ধান্ত নেন সিরিজটি শেষ করার জন্য তিনটি বই লেখা হবে। এই তিনটির প্রথম বই ‘দ্য গ্যাদারিং স্টর্ম’ প্রকাশের পরপরই নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্টসেলার তালিকার প্রথম স্থানে চলে আসে।
ব্র্যান্ডন স্যান্ডার্সন বিশাল ক্যানভাসে, দারুন জটিল সিস্টেমকে অত্যন্ত আকর্ষনীয়ভাবে ফুটিয়ে তুলতে ভালোবাসেন। কতখানি বিশাল তাঁর ক্যানভাস? একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে – তাঁর স্টর্মলাইট আর্কাইভের প্রথম তিনটি বই এব্ং একটা নভেলা – এই সোয়া তিনটা লেখাকেই একসাথে করলে প্রায় ৩,৬০০ পাতা হয়! ডজন খানেকেরও বেশী মূল চরিত্র, হাজার বছর ধরে কাহিনির ব্যপ্তি আর কয়েকটি স্বয়ং সম্পূর্ণ ম্যাজিক সিস্টেম, যারা প্রত্যেকেই একে অন্যের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সব মিলিয়ে এক কথায় মাইন্ড ব্লোওইং!
২০০৫ সালে স্যান্ডার্সনের ‘এলানট্রিস’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। একদা জাদুবিদ্যার শিখরে থাকা, বর্তমানে পরিত্যক্ত একটি শহরকে কেন্দ্র করে বইটি লেখা। এলানট্রিসে স্যান্ডার্সন সম্পূর্ণ নতুন একটা জাদু ব্যবস্থা উপস্থাপন করেন পাঠকদের সামনে। পাবলিশার্স উইকলির মন্তব্য অনুযায়ী বইটা “নিজেই স্বয়্ং সম্পূর্ণ, এই জনরার প্রচলিত ক্লিশেগুলো থেকে পুরোপুরি মুক্ত। পাশাপাশি পাঠককে নিবিড়ভাবে ধরে রাখার সব ধরনের উপাদান এতে বিদ্যমান – রহস্য, জাদুবিদ্যা, রোমান্স, রাজনীতির দুর্ধর্ষ টানাপোড়েন, অধিকার আদায়ের যুদ্ধ, চরিত্রগুলোর ব্যপ্তি আর তার সাথে সুতীক্ষ্ন লেখনী।”
স্যান্ডার্সনের পরবর্তী উপন্যাস মিস্টবর্ণ ত্রয়ীর (ট্রিলজি) প্রথম বই – মিস্টবর্ণঃ দ্য ফাইনাল এম্পায়ার। এই কাহিনি আবার আপাতঃদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা জগতে, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা দুর্দান্ত ম্যাজিক সিস্টেমের প্রেক্ষিতে লেখা। কিন্তু আসলে স্যান্ডার্সন ভিন্ন ভিন্ন ফ্যান্টাসি সিরিজ লিখছেন না। প্রাথমিকভাবে একটার সাথে আরেকটার কোন সম্পর্ক নেই বলে মনে হলেও তাঁর লেখা প্রায় সবগুলো কাহিনি একটা বিশাল ইউনিভার্সের মধ্যে দিয়ে আবর্তিত হচ্ছে। হ্যাঁ, এলানট্রিস, মিস্টবর্ণ বা স্টর্মলাইট আর্কাইভ- এগুলো প্রত্যেকে নিজ নিজ গ্রহে সংঘটিত হচ্ছে, প্রত্যেকের নিজস্ব আলাদা ম্যাজিক সিস্টেম, ইতিহাস, সংস্কৃতি আছে। কিন্তু এরা সবাই একটা ফ্যান্টাসি ইউনিভার্সের অন্তর্গত, যে ইউনিভার্সের নাম- “কজমেয়ার”।
২.
কিন্তু কজমেয়ারের যাদুকরী জগত নিয়ে বলার আগে স্যান্ডার্সনের লেখার ধারাবাহিকতাটা শেষ করে নিই। ২০০৬ সালে স্যান্ডার্সনের মিস্টবর্ণ ত্রয়ীর প্রথম বই প্রকাশ হয়। মিস্টবর্ণঃ দ্য ফাইনাল এম্পায়ার বইটি দিয়ে স্যান্ডার্সন বেশ বড়সড় একদল পাঠকের কাছে পৌঁছে যান। পরের বছর প্রকাশ পায় এই সিরিজের দ্বিতীয় বই “দি ওয়েল অব এসেনশন”।
এই ২০০৭ সালই আরো বড় একটা চমক নিয়ে অপেক্ষা করছিল তাঁর জন্য। আপামর ফ্যান্টাসি পাঠকদের বিশাল একটা অংশের খুব প্রিয় ফ্যান্টাসি সিরিজ “দ্য হুইল অব টাইম”। সিরিজটি অসমাপ্ত থাকতে থাকতেই এই সিরিজের লেখক রবার্ট জর্ডান আকস্মিকভাবে চির না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। জর্ডানের বিধবা স্ত্রী হ্যারিয়েট ম্যাকডোগাল স্যান্ডার্সনকে আমন্ত্রণ জানান এই সিরিজটি শেষ করার জন্য। স্যান্ডার্সনের জন্য এটি ছিল অনেকটা স্বপ্নের মত। রবার্ট জর্ডান ছিলেন তাঁর স্বপ্নের লেখক, হিরো! স্যান্ডার্সনের নিজেই বলেছেন জর্ডানের লেখা থেকে তাঁর লেখা অনেকাংশে অণুপ্রাণিত। এখন তাঁর হিরোর এপিক সিরিজ সফলভাবে সমাপ্ত করার গুরুদায়িত্ব এসে পড়লো তাঁর কাঁধে।
পরবর্তী কয়েক বছর স্যান্ডার্সন দ্য হুইল অব টাইম নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও পাশাপাশি নিজের সিরিজ নিয়েও লেখা চালিয়ে যান। হুইল অব টাইমের শেষ তিনটি বই – দ্য গ্যাদারিং স্টর্ম, টাওয়ার্স অব মিডনাইট আর আ মেমারি অব লাইট প্রকাশের সাথে সাথে বেস্ট সেলারের তালিকার প্রথমে চলে আসে। শুধু তাই নয় – পাঠকরা একবাক্যে স্বীকার করে নেন যে এই তিনটি বই হুইল অব টাইমের বিশাল সিরিজে অন্যতম সেরা তিনটি বইয়ের মধ্যে পড়ে। লক্ষ লক্ষ পাঠকের কাছে জনপ্রিয় একটা ফ্যান্টাসি সিরিজের অত্যন্ত সফলভাবে পরিসমাপ্তি টেনে দেয়ার দুরূহ কাজটা স্যান্ডার্সন সুচারুরূপে পালন করেন। বলা যায়, তাঁর এই কাজের মাধ্যম দিয়ে তিনি ফ্যান্টাসি জগতের অন্যতম মহীরূহে পরিণত হন।
একই সময়ে তিনি তাঁর মিস্টবর্ণ ত্রয়ীর শেষ বই “দ্য হিরো অব এজেস” শেষ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি এ সময়ে আলকাট্রাজ সিরিজ (ইয়াং এডাল্ট ) এবং একক ফ্যান্টাসি উপন্যাস “ওঅর ব্রেকার” লিখে শেষ করেন।
কিন্তু স্যান্ডার্সনের সবচেয়ে নজরকাড়া, উচ্চাভিলাষী প্রজেক্ট হচ্ছে স্টর্মলাইট আর্কাইভ। এই সিরিজের প্রথম বই “দি ওয়ে অব কিংজ” প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে, দ্বিতীয় বই “ওঅর্ডস অব র্যাডিয়েন্স” ২০১৪ সালে, তৃতীয় বই “ওথব্রিঙ্গার”২০১৭ সালে, আর চতুর্থ বই “রিদম অব ওঅর” ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়া “এজড্যান্সার” ও “ডনশার্ড” নামে দুটি নভেলাও প্রকাশিত হয়। স্যান্ডার্সনের পরিকল্পনা অনুযায়ী এই সিরিজে মোট ১০টি বই থাকবে। স্টর্মলাইটের পাশাপাশি এই সময়ে মিস্টবর্ণ সিরিজের পরবর্তী ত্রয়ীর (মিস্টবর্ণ এরা ২ অথবা ওয়্যাক্স এন্ড ওয়েইন ট্রিলজি) তিনটি বই “দি এলয় অব ল”, “শ্যাডোজ অব সেলফ” এবং “দ্য ব্যান্ডস অব মোর্নিং” প্রকাশিত হয়। মিস্টবর্ণ সিরিজেরও কয়কটি নভেলা লিখেছেন স্যান্ডার্সন। এগুলো যথাক্রমে “দি ইলেভেন্থ মেটাল” (মিস্টবর্ণ এরা ১, ০.৫), অ্যালোম্যান্সার জ্যাক অ্যান্ড স্য পিটস অব এলটানিয়া” (মিস্টবর্ণ এরা ২, ১.৫), “মিস্টবর্ণঃ সিক্রেট হিস্ট্রি” (এরা ১, ৩.৫)। এছাড়াও স্যান্ডার্সন বেশ কয়েকটি একক নভেলা এবং ছোটগল্প লিখেছেন। যেমন “দি এমপেরার্স সৌল”, “শ্যাডোয ফর সাইলেন্স ইন দ্য ফরেস্টস অব হেল”, “সিক্সথ অব ডাস্ক”, এই নভেলা, ছোটগল্প এবং আগে উল্লেখ করা নভেলাগুলোর কয়েকটা একসাথে পাওয়া যাবে “আরকানাম আনবাউন্ডেড” নামের সংকলনে। উপন্যাস, উপন্যাসিকা, ছোটগল্প ছাড়া হোয়াইট স্যান্ড সিরিজের তিনটি গ্রাফিক নভেলও আছে, যেগুলোও কজমেয়ার জগতের অন্তর্গত।
এই তো গেলো সংক্ষেপে স্যান্ডার্সনের প্রকাশিত বইগুলোর কথা। পরের পর্বে কজমেয়ার নিয়ে আলোচনা করবো। কোনরকম স্পয়লার না দিয়ে ব্যপক আলোচনা করা দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে। তাই মোটামুটি “ধরি মাছ না ছুঁই পানি” গোছের একটা আলোচনা হবে হয়তো এটা। দেখা যাক কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
ছবিঃ মাইকেল ওয়েল্যানের আঁকা ওঅর্ডস অব র্যাডিয়েন্স
Leave a comment