“বৃহন্নলা” আমার পড়া অসাধারণ একটা মৌলিক সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার।
হুমায়ূন আহমেদ এর লেখনীর সবচেয়ে চমতকার দিক হচ্ছে তার রহস্যময়তা সৃষ্টি। গল্পের পরিবেশ তিনি এত সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেন, পাঠকের চোখের সামনে যেন স্পষ্ট ফুটে ওঠে। এ প্রসংগে এই গল্পের-ই কিছু অংশের বর্ণনা দেওয়া যাক। তা হলে পাঠকেরা বুঝতে পারবেন।
“কুয়ার পানি নদীর পানির মতো গরম নয়,খুব ঠান্ডা। পানি গায়ে দিতেই গা জড়িয়ে গেল। সারা দিনের ক্লান্তি,বিয়েবাড়ির উদ্বেগ, মৃত্যুসংক্রান্ত জটিলতা সব ধুয়ে মুছে গেল। চমত্কার লাগতে লাগলো।তা ছাড়া পরিবেশ টাও বেশ অদ্ভুত। পুরনো ধরণের বাড়ি। ঝকঝকে উঠানের শেষ প্রান্তে শ্যাওলা- পড়া প্রাচীন কুয়া।আকাশে পরিষ্কার চাঁদ।কামিনী ফুলের গাছ থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি গন্ধ।” পরিপার্শ্বের কী চমত্কার বর্ণনা।
এই গল্পের শুরু টা হয় বিয়েবাড়ির আয়োজন দিয়ে।
গল্পকথক তার ফুপাতো ভাই এর বিয়ের জন্য গ্রামে আসে। দুর্ভাগ্যক্রমে বিয়েটা না হওয়ায় ছেলেপক্ষকে আটকে থাকতে হয় এক রাতের জন্য। ওই রাতের জন্য গল্পকথকের থাকা -খাওয়ার ব্যবস্থা হয় সুধাকান্ত ভৌমিক নামক এক লোকের বাড়িতে। সেই রাতেই সুধাকান্তের জবানিতে এক রহস্যময় অভিজ্ঞতার কথা শুনেন তিনি। যার কোনো কূল-কিনারা তিনি করতে পারেন নি।
বৃহন্নলা শব্দটা এসেছে পৌরাণিক কাহিনি থেকে। মহাভারতের অর্জুন তার অজ্ঞাতবাসের কিছুটা সময় নিজের পরিচয় গোপন করে তৃতীয় লিংগের রুপ ধারণ করেছিল এবং এ সময়টাতে সে বৃহন্নলা নাম ধারণ করে।
অনুমান করি, লেখক এই কারণেই হয়ত বইয়ের নামকরণ করেছেন বৃহন্নলা। বইয়ের মূলচরিত্র ও গোপনীয়তার আশ্রয় নিয়েছিলো নিজেকে প্রকাশের ক্ষেত্রে।
গ্রামের মানুষজন সুধাকান্তবাবুকে সাধুবাবা বলে ডাকতো তার ঋষির মত জীবনযাপন এর জন্য। স্কুলশিক্ষক সুধাকান্তবাবু অবিবাহিত ছিলেন,জীবনযাপন ও ছিল সরল,নিরুদ্রপ। সেই নিরুদ্রপ জীবনে একবার এক আধিভৌতিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। সেই ঘটনাই সুধাকান্তবাবু নিজের মুখে গল্পকথক কে শুনায়। কথক এই গল্প পরে অনেকের কাছেই করে যা এক সময় মিসির আলী সাহেবের কানে পৌছায়।
” বৃহন্নলা” মিসির আলী সিরিজ- এর গল্পগুলোর মধ্যে একদম প্রথমদিকে থাকবে একাধারে রহস্য, ভয়, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার সন্নিবেশের কারণে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই গল্পে মিসির আলীর আগমন ঘটে অনেক পরে, প্রায় শেষের দিকে।
হুমায়ূন আহমেদ নিজেকেই গল্পকথকের নাম ভুমিকায় রেখেছেন দেখে মনে হয় এই গল্পটা তার নিজের ই অভিজ্ঞতালব্ধ কোনো ঘটনা থেকেই হয়ত নেয়া। অন্তত একটা গল্পে নিজেকে তার সেরা সৃষ্টি মিসির আলীর মুখোমুখি দাড় করিয়েছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা রহস্যময় গল্পগুলোর মাঝে বৃহন্নলা অন্যতম সেরা সংযোজন।
Leave a comment