‘সুখে দুঃখে ছিল একে অন্যের সাথি,
হিন্দু এবং মুসলমানে ছিল সম্প্রীতি’
—বাউলকবি শাহ আবদুল করিম
গান্ধীর মৃ ত্যু পরবর্তী দেশ-ভাগের কাঁ টা তা রে আটকে পড়া সংখ্যালঘুদের এক অ্যাখ্যান।
ফেনী মহকুমার তালুকদার পরিবার। হিন্দু-মুসলিম-নমশূদ্র নির্বিশেষে ❝কত্তা❞ সম্বোধন করে মুরলীধর দাসকে। তালুকদারি আর হার্ডওয়্যারের দোকান দিয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার করাল গ্রাস পড়লো তাদের উপরও। হিন্দুস্তানে কচু কাঁ টা হচ্ছে মুসলিম। আর পাকিস্তানে ম র ছে হিন্দু। শত নি র্যা ত নে র পরেও পূর্ব পাকিস্তানের ফেনীর মাটি ছাড়তে নারাজ মুরলী। তার ভাষায়, ❝অ্যার দেশের মাটি, ফেনীর মাটি ছাড়ি যাইতন ন❞। গান্ধীর মতাদর্শে বিশ্বাসী অশ্বিনী মাস্টার আশঙ্কা প্রকাশ করে। থাকতে পারবে তো নিজের দেশে? নাকি সংখ্যালঘু হিসেবে বিদেশ বিভূঁইয়ে পাড়ি জমাতে হবে?
স্বাধীন পাকিস্তান পাবার পরে সুধীনের বাবা অম্বিকা কর স্বপ্ন দেখেন স্বাধীন পূর্ববাংলার। ৪৭ এর সেই ১৪ই আগস্ট ❝পাকিস্তান জিন্দাবাদ❞ ধ্বনির সাথে তিনি হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন স্বাধীন পূর্ববাংলার স্বপ্ন। সুধীরের কন্যা সত্যবতীও দাদা অম্বিকার সুরে সুর মিলিয়ে বলে, ❝দাদু, আঁর সোনার বাংলা জিন্দাবাদ!❞ স্বপ্ন পূরণ হবে কি? সংখ্যালঘু হয়ে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারবে কি মুরলী, সুধীন, অশ্বিনীর মতো পাকিস্তানী সংখ্যালঘুরা?
সুধীরের স্বপ্ন মেয়েকে তিনি ডাক্তার বানাবেন। স্বপ্ন কি পূরণ হবে এই জীবনে?
ধর্ম কি নৃশংস হতে শেখায়? ধর্মের আসল শিক্ষা কি অন্য ধর্মাবলম্বীদের র ক্তে নিজেকে রাঙানো? হিন্দুর হাতে মুসলিমের র ক্ত বা মুসলিমের হাতে হিন্দুর র ক্ত এই কি ছিল দেশভাগের সুফল? মাইগ্রেশনের একটা কাগজ-ই কি জন্মভূমির আকাশ, বাতাস, মাটি, স্মৃতি ভুলিয়ে দিতে যথেষ্ঠ?
জন্মভূমির শেকড় ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে নতুন শেকড় গড়লেই কি সেই ভিত শক্ত হয়?
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
ইতিহাসের অন্যতম বিষয় ১৯৪৭ এর দেশভাগ। একসাথে এত লোকের উদ্বাস্তু বনে যাওয়ার ইতিহাস, শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগের ইতিহাস হয়তো আমাদেরই। একদিনের ব্যবধানে দুইটি স্বাধীন দেশের জন্ম।
লেখক যে আবেগ দিয়ে ২০৮ পৃষ্ঠার বইটি লিখেছেন সে আবেগ শুধু নিজে প্রত্যক্ষ না করলে লেখা সম্ভব না। দেশভাগের নামমাত্র সুফলে অ ত্যা চা র ভোগ করা পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন। ইতিহাসের বর্ণনার পাশাপাশি নিজ দেশ নিজ মাটির প্রতি গভীর টান, মমত্ববোধ অনুধাবন করা সংখ্যালঘুদের দুঃখের কথা লেখক অসাধারণভাবে বর্ণনা করেছেন। পাকিস্তানে হিন্দু নি ধ ন, উল্টোদিকে হিন্দুস্তানে মুসলিম নি ধ ন চলছে। কতটা অসহায় ছিল সে সময়কার সংখ্যালঘুরা, সে চিত্রই লেখক কলমের খোঁচায় তুলে ধরেছেন।
হিংস্র সাম্প্রদায়িক মানুষের ভীড়েও সৈয়দ, সোনা মিঞা, টুক্কুর মতো মেজরিটির খুব প্রয়োজন। সেরকম লোক ছিল বলেই শত দুঃখের মাঝেও একটু ঠাঁই ছিল।
মুরলীর মতো কতশত তালুকদারের এক আইনে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া, সুনীতি-সুহাসের পরিণতি, সুধীরের মেয়ে সত্যবতীর পরিণতি সবকিছু যেন বুক ভাঙ্গা কষ্টের উদ্রেক করছিল।
বিশাল ইতিহাসের প্লটে রচিত উপন্যাস ❝বিয়োগপর্ব❞। ইতিহাসের বহুল বর্ণনা, রান্নার কৌশল শেখানো, পথের পাঁচালীর কথার ভীড়ে উপন্যাসের চরিত্রগুলো নিজেদের পরিপূর্ণ ভাবে মেলে ধরতে পারেনি। মুরলীর মাঝেও কিছুটা গোড়ামি ছিল। সুধীর, সোনা মিঞা চরিত্র দুটো আমার খুবই পছন্দ হয়েছে।
ইতিহাস ভালো না লাগলে বইটা পড়তে ভালো নাও লাগতে পারে। ইতিহাস নিয়ে আমার অতি আগ্রহের কারণে ইতিহাসের বহুল বর্ণনায় রচিত বইটা আমার ভালো লেগেছে।
পত্রভারতী প্রকাশিত বইটি বাংলাদেশে প্রকাশ করেছে ❝ভূমি প্রকাশ❞।
বই: বিয়োগপর্ব
লেখক: দেবতোষ দাশ
এই বিউটি যাদের কাছে ভালো লাগে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন।