বাজিকর। গুপ্তচরবৃত্তিতে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে উপমহাদেশে এই নামেই বৃটিশ আমল থেকে ডাকা হয়ে আসছে। দেশভেদে উর্দু এবং হিন্দীতে ‘বাজিগর’ হিসেবেই চিনে এসপিওনাজ জগতের মানুষজন। পৃথিবীজুড়েই ভাষাভেদে বিভিন্ন নামে তাঁরা আছেন। মোসাদ, এমআইসিক্স, সিআইএ আরো অনেক এজেন্সিতেই।
এই বাজিকরদের উপর বাজি ধরা হয় যার যার সংস্থা থেকে। আবার বাজিকর ট্রিলজির প্রথম পর্বে আহাদ নিজের উপরই বাজি ধরেছিল। থামিয়েছিল আমেরিকা বনাম রাশিয়া যুদ্ধ। হারিয়েছিল নিজের প্রিয় সিনিয়র এজেন্টদের। দক্ষ ফিল্ড এজেন্ট থেকে পরিণত হয়েছিল বাজিকরে।
বাজি। দ্বিতীয় পর্বে কোমা থেকে উঠে আসা বাবুর উপর বাজি ধরেছিলেন দু’শর বেশি আইকিউ সম্পন্ন মাস্টার স্ট্রাটেজিস্ট সিফাত। সব হারানো বাবু একের পর এক ভিনদেশি বাজিকরদের বিরুদ্ধে যে মরনপণ যুদ্ধে নেমেছিলেন একদম ঘাড়ত্যাড়ার মত তা বহুদিন মনে থাকবে। বাবুর জন্য মনটা বিষন্ন হয়ে থাকবে আরো কতদিন।
‘দ্য এজেন্সি’ কম্প্রোমাইজড। বাংলাদেশের আদর্শবাদি প্রধানমন্ত্রি গাজী সোবহানুল ইসলামের প্রাণ বাঁচিয়েছেন একদল রহস্যময় এজেন্ট। দ্য এজেন্সি পরিণত হয়েছিল দ্য অক্টোপাসের শুঁড়ে। সেই শুঁড় উপড়ে ফেলেছেন আহাদ, কাপ্তান গৌতম, বাবু ও জলিল চাচা। তবে সোবহানুল ইসলাম এবং তাঁর কন্যা আনিলার উপর নিরাপত্তা ঝুঁকি মোটেও কমেনি। বরঞ্চ বেড়েছে।
বিশ্বের খ্যাতিমান তরুন উদ্দ্যোক্তা ভার্চুয়া সামাজিক মাধ্যমের কর্ণধার মাইক জিমারম্যান সরাসরি বাংলাদেশ এসেছেন। অক্টোপাসের প্রায় সকল তথ্য বংশীবাদক ডট কমের চালক কার্ল হাসান সেভার্স একদম উধাও। তাঁকে জীবন্ত দরকার জিমারম্যানের। প্রধানমন্ত্রি এবং তাঁর কন্যার জীবন হুমকিতে ফেলে কার্লকে চান বিনিময়ে ‘দ্য অক্টোপাস’ এর প্রধান। কারণ এই কার্লের হাতেই আছে উত্তর কোরিয়া এবং আমেরিকার মাঝে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়ার ক্ষমতা।
বয়সে তরুণ দ্য এজেন্সির এজেন্ট আসাদ কেন দার্জিলিং এ? নিজের ব্যক্তিগত বিষয়ের পাশাপাশি আসাদের লক্ষ্য আরো বেশি মনোযোগ পায় দালাই লামার উত্তরসুরির ব্যাপারে। এই যাত্রায় মিশনের সব কোড ভেঙে ফেলেছেন আসাদ। তিন্নি কি ঠিকমত দেশে ফিরতে পারবে?
ট্রাভিস আরভাইন এক ছোট্ট মফস্বল শহর সংলগ্ন জঙ্গলে ভালোই জীবন কাটাচ্ছিলো। গতবার দ্য অক্টোপাসের ষড়যন্ত্রে পা রাখেন নি দ্য লুনাটিক খ্যাত সেরা সিআইএ এজেন্ট। বাংলাদেশে যান নি তিনি বাজিকর বাবুকে ফেইস করতে। তবে ঘটনাচক্রে ট্রাভিস আরভাইন আবার পরিণত হতে যাচ্ছেন ‘দ্য লুনাটিক’ এ। নিজ দেশের বিরুদ্ধে নেমে পড়েছেন কেন ট্রাভিস?
মাস্টার সিফাত নিরুদ্দেশ। সিরিয়াতে আইএসের যোদ্ধা হয়ে লড়ছেন কেন সাবেক বাজিকর সমশের? তাঁর উদ্দেশ্য ঘোলাটে। এদিকে খোদ সমশেরের বয়ানে প্রকৃত বাজিকর রোখসানা সব ছেড়ে সংসারধর্মে মেতেছেন। তবে খুব শীঘ্রই ঝড় আসছে সাবেক এজেন্ট রোখসানার উপর। কাপ্তান গৌতম চাচ্ছেন ‘দ্য এজেন্সি’ কে নতুন করে সাঁজাতে। কিন্তু ঐ সংস্থার প্রাক্তন প্রধান আতিয়ারের অনুগতরা আহাদ, রোখসানা, কাপ্তান গৌতমের প্রাণের উপর আদাজল খেয়ে নেমেছেন। এখন সবাইকে ফিরে যেতে হবে রিটায়ার্ড ওল্ড স্কুল আরেক মাস্টার স্ট্র্যাটেজিস্টের কাছে।
মাইক জিমারম্যান এই শো এর শেষের শুরু করেছেন। কার্লকে ব্রেইনওয়াশ অথবা ম্যানিপুলেট করে, নিজের ডামি আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে হাত করে উত্তর কোরিয়ার সাথে এমন এক সংঘর্ষ লাগাতে চান যা কিনা সূচনা করবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের। প্রায় সব নাটকের যবনিকাপাত হচ্ছে। বাজিকর আহাদের পুরনো কোন অতীত কি ছুটে আসছে পিছন থেকে? যা তাঁকে মানসিক এবং শারিরীকভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে। পার্কুর লাফঝাপ এবং ভাগ্য কি এবার সহায় হবে আহাদের?
নাবিল মুহতাসিমের বাজিকর ট্রিলজির শেষ খন্ড পাঠ শেষ হল আজ। এসপিওনাজ নভেল কম পড়া হয়নি। তবে নাবিল নিজস্ব লেখনীতে যেন লেখক হিসেবে বাজিমাত করেছেন। বাজিকর সিরিজের প্রতিটি খন্ড একটি থেকে আরেকটি উত্তরোত্তর ব্যাটার হয়েছে। বিভিন্ন বাজিকরের ভিন্ন ব্যক্তিত্ব, ব্যাটল মনস্তত্ত্ব, ব্যক্তিগত জীবনের বিপন্নতা এবং ট্রাজেডি সুন্দর চিত্রায়ণের মাধ্যমে একদম চোখের সামনে মেলে ধরেছেন নাবিল মুহতাসিম। তাছাড়া লেখকের দুর্দান্ত উইট বিভিন্ন সময় ভালো কমিক রিলিফ দিয়েছে। একশন দৃশ্যগুলো নিয়ে আর নতুন করে কিছু বলতে চাই না। মনে হয় মাথার ভিতর একটি ফিল্ম চালু হয়ে ছিল পুরো বইয়ে। দার্জিলিং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সিরিয়ার ভয়াবহ পরিস্থিতি, ভূরাজনীতির জটিল প্যাঁচগোছ লেখক প্রাঞ্জল ভাষায় চমৎকার লেখনীর মাধ্যমে বলে গেছেন। বাজিকর আহাদের অরিজিন স্টোরিও আছে এই আখ্যানে। লেখক টানটান উত্তেজনা টিকিয়ে রেখেছেন পুরো গ্রন্থটি জুড়ে তেমন টুইস্ট এবং গিমিকের উপর নির্ভর না করেই। এটি সম্ভব হয়েছে তাঁর একধরণের সার্কাজম এবং সিরিয়াসনেসের যৌথতায় নৈরাজ্যপূর্ণ অদ্ভুত গল্পকথনের মাধ্যমে। বাজিমাত করেছেন নাবিল মুহতাসিম। আজ লেখকের জন্মদিন। তাঁর প্রতি জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা রইল।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ খেলা জমবে একটি পারমানবিক অস্ত্রে সজ্জিত এয়ারক্রাফট ক্যরিয়ারে। শেষ রহস্যরোমাঞ্চপূর্ণ টানটান উত্তেজনাময় অভিযানের যবনিকাপাত ঘটতে যাচ্ছে সেখানেই। বাজিকর হয়তো অনেক, বাজি লাগিয়েছেন তাদের উপর কেউ কেউ বা তাঁরা নিজেরাই নিজেদের উপর। তবে শেষ পর্যন্ত বাজিমাত করবেন একজনই। এই ট্রিলজি এক সূত্রে কোথায় যেন গাঁথা এই বিখ্যাত কবিতার সাথে-
জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
মানুষ বেকুব চুপ, হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর ৷
চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,
বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পূর্ণিমার চান,
নিজেই তাজ্জব তুমি একদিকে যাইবার চাও
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান৷
সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,
খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,
ডাহুক উড়ায়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,
সোনার মোহর তার পড়া থাকে পথের ধূলায় ৷
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর ৷
-পরাণের গহীন ভিতর
সৈয়দ শামসুল হক
বুক রিভিউ
বাজিমাত
লেখক : নাবিল মুহতাসিম
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২০
প্রকাশনা : বাতিঘর প্রকশনী
প্রচ্ছদ : ডিলান
জনরা : এসপিওনাজ থ্রিলার
রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ
Leave a comment