বাজিকর। ইংরেজ আমলে গুপ্তচরবৃত্তির সেরাকে উপমহাদেশে এই উপাধি দেয়া হত। ভাষার তারতম্যের কারণে দেশভেদে উপাধি ভিন্ন নাম পায়। তবে অর্থ একই থাকে, সেরা এসপিওনাজ এজেন্ট।
ভূরাজনৈতিক সমীকরণে ইউক্রেন বনাম রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এর মাঝে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী গাজী সোবহানুল হকের মেয়ে আনিলা হক বিমান হাইজ্যাকের শিকার হয়ে যান। অপহৃত আনিলা হককে উদ্ধার করতে জটিল ঐ স্থানে বাংলাদেশের সেরা “দ্য এজেন্সি” কে পাঠানো হয়।
“দ্য এজেন্সি” বাংলাদেশের সেরাদের সেরা ইন্টেলিজেন্স সংস্থা। তাদের মটো হল “আমরা এটম বম্ব বানাই না, মানুষ তৈরি করি।” অমানবিক এবং কঠোরতম প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সবচেয়ে দক্ষ এবং দেশপ্রেমিক গুপ্তচরদের। তাছাড়া এই রেসকিউ মিশনে আনিলা হকের সাথে ছিলেন ঐ এজেন্সির সবচেয়ে মূল্যবান অ্যাসেট, বাজিকর জনি।
এরূপ ঘোলাটে জিওপলিটিক্যাল পরিস্থিতিতে আরো ঘটনা ঘটে যায়। বাংলাদেশি রক্তধারা ধমনীতে বইছে এরকম এক সিআইএ এজেন্ট ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসেন এদেশে। পৃথিবীজুড়ে রাজত্ব করে আসা এক গুপ্তসঙ্ঘ সম্পর্কে এমন কী জেনে গেছেন কার্ল? যেকারণে রহস্যময় কর্নেল সেবাস্তিয়ান প্রধানমন্ত্রীর মেয়ের পরিবর্তে কার্লকে চান।
“দ্য এজেন্সি” এর দ্বিতীয় সেরাকে কোমা থেকে সঠিকভাবে তুলতে পারেনি সংস্থাটি। তৃতীয় সেরাকে লিডার বানিয়ে ছয়জনের এক টিম গঠন করা হয় এই রেসকিউ মিশনে। বিহাইন্ড দ্য এনিমি লাইনে বাংলাদেশের খুব সম্ভবত শেষ ভরসা পাঁচজন ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে এক্সপার্ট এজেন্ট এবং একজন হাই পারফর্মেন্স অপারেটিভ আহাদ।
ভূরাজনৈতিক নৈরাজ্যের সুযোগ নিয়েছে রাশিয়াপন্থী ইউক্রেনের মিলিশিয়ারা। তাঁরা এমনসব জঘন্য কাজ করে বেড়াচ্ছে যে খোদ মাদার রাশার কর্তাব্যক্তিদের জানা নেই। বাজিকর জনির পোষ্যপূত্র আহাদ শত্রুদেশে পৌছেই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখে পড়ে যান। কারণ তাদের ছয়জনের টিমের বিপরীতে আছে কর্নেল সেবাস্তিয়ানের নেতৃত্বে এক নৃশংস ছয়জনের দশ। যেখানে দুইশ আইকিউর মাস্টারমাইন্ড, বোমাবিশেষজ্ঞ, দানবীয় এজেন্ট, সুপার সোলজার, লক্ষ্যভেদি এবং সেবাস্তিয়ান স্বয়ং। “দ্য এজেন্সি” এর ছয়জন যেন কিছু নয় এই বিশ্বসেরাদের সামনে।
রেসকিউ অভিযানের সাথে যুক্ত হয় “সার্চ” এর কাজও। বিদেশবিভুয়ে একদম কোনঠাসা হয়ে পড়া আহাদ যেন ডেভিড হয়ে কমপক্ষে ছয়জন গোয়ালিয়াথের মুখোমুখি হয়ে পড়েছেন। বাজিকর জনির কাছ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আহাদের সামনে এক অসম্ভব অভিযান যেন জগদ্দল পাথরের মত দাড়িয়ে আছে।
নাবিল মুহতাসিমের লিখার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে “স্বাপদ সনে” এর গ্রাফিক নভেল অ্যাডাপ্টেশনের কারণে। এছাড়া “গল্পগাথা” সংকলনে তাঁর “তাম্বুল হৈল রাতুল” গল্পটি আমার খুব ভালো লেগেছিলো। একদম নিজস্ব স্টাইলে গল্পকথন করে গেছেন নাবিল। তাঁর স্টোরিটেলিং এ চলে আসে ঐতিহাসিক চরিত্রদের খানিক ঝলক, কবিতা, গান এবং দারুন উইট। দ্রুতগতির এই রহস্যরোমাঞ্চ ভর্তি আখ্যান এক বসায় পড়ার মত। বিশেষ করে মানুষের সুপ্ত ব্যক্তিসত্ত্বার তীব্র জাগরণ যেমন পাওলো কোয়েলহোর বইয়ে পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি নাবিল মুহতাসিম এসপিওনাজ নভেলের মোড়কেও একইধরণের কাজ করেছেন। তাছাড়া একশন দৃশ্যগুলোর চিত্রায়ণ লেখক করেছেন দারুনভাবে।
ক্রিটিকেরও কিছু জায়গা আছে। মুদ্রণপ্রমাদ নিয়ে আমার তেমন সমস্যা নয় না তবে দু’টি জায়গায় চরিত্রের ক্ষেত্রে একজনের জায়গায় আরেকজনের নাম চলে আসায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। আশা করছি পরবর্তি সংস্করণে ঠিক করে নেবেন লেখক-প্রকাশক। বেশ গতি সম্পন্ন গল্পের এই প্লট কোন আহামরি বা গ্রাউন্ডব্রেকিং নয় তবে নাবিলের একধরণের ক্যাওটিক স্টোরিটেলিং আমার খুব ভালো লেগেছে। কোন কিছুর প্রতি প্যাশনেটলি লেগে থাকাটা একধরণের মোটিভেশনও দিতে পারে পাঠকের মনে অজান্তেই।
বাজিকর ট্রিলজির তিনটি বই-ই আমার সংগ্রহে আছে। মিনিমালিস্ট এপ্রোচে, অদরকারি তথ্য-তত্ত্ব না এনে এক প্রিসাইজ আখ্যান লিখেছেন নাবিল মুহতাসিম। আমি অদূর ভবিষ্যতে বাকি দু’টির রিভিউ লিখতে পারি, পড়া শেষে। আমার মনে হয় দুর্দান্ত এক ট্রিলজির শুরুটা করলাম মাত্র।
জীবন অনেক সময় জুয়ায় পরিণত হয়। সবকিছু হারানোর ঝুঁকি থাকার পরও মানসিক শক্তির বলে নিজের সুপ্ত ব্যক্তিসত্ত্বার জাগরণের মাধ্যমে নিজের অজান্তেই কেউ কেউ পরিণত হয়ে যান বাজিকরে।
বুক রিভিউ
বাজিকর
লেখক : নাবিল মুহতাসিম
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৭
দ্বিতীয় সংস্করণ : মার্চ ২০১৮
প্রকাশনা : বাতিঘর প্রকাশনী
প্রচ্ছদ : নিউটন
জঁরা : এসপিওনাজ নভেল, রহস্যরোমাঞ্চ, একশন-অ্যাডভেঞ্চার।
রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ
Leave a comment