এক নজরে:
বই – বউ সোহাগি
লেখক – রোকসানা রহমান
প্রচ্ছদ – জাওয়াদ উল আলম
প্রকাশনী – বর্ণলিপি প্রকাশনী
জনরা – সামাজিক উপন্যাস
প্রকাশকাল – ১ অক্টোবর , ২০২১
পৃষ্ঠা – ১৭৫
মলাট মূল্য – ২৪৯ টাকা
লেখনীতে – তাসফিয়া নূর তাম্মি
🔸ভূমিকা:
প্রথমবারের মতো লেখকের বই পড়লাম। এর আগে হয়তো ফেসবুকে ছোটগল্প পড়েছিলাম। মনে নেই আসলে পড়েছি কী না। সেদিন মোহসিনা আপু কয়েকটা বইয়ের ছবি দিয়ে বলল এখান থেকে কোনোটা নিতে চাইলে নিতে পারো। প্রথমে নিষেধ করলেও পরে কেন যেন ‘বউ সোহাগি’ বইটা দিতে বলি আপুকে। আর আপুও আমাকে অপেক্ষা না করিয়ে শীঘ্রই বইটা পাঠিয়ে দেয়। প্রথম থেকেই নামটা দেখে আগ্রহ জন্মেছিল। কিন্তু বইটা ভালো লাগবে কী না সেটা নিয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু নাহ আমার খুব ভালো লেগেছে।
🔸পারিপার্শ্বিক দিক:
আমার এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। কিন্তু আমি তো বইপোকা মানুষ। একাডেমিক বই জলে যাক কিন্তু আমার তো নন-একাডেমিক বই পড়তেই হবে। না হয় যে আমি শান্তি পাই না। একে একে সংগ্রহের বইগুলো ধরছি আর রাখছি কিন্তু কোনোটাতেই মন বসেনি। শেষ পর্যন্ত বউ সোহাগিকে সিলেক্ট করি। ভেবেছিলাম অতটা টানবে না বইটা। আস্তধীরেই ৫-১০ পৃষ্ঠা করে পড়ে শেষ করব৷ কিন্তু বইটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করেই যেন আটকে গিয়েছি। দুইদিনে বইটা পড়ে শেষ করেছি।
🔸প্রচ্ছদ ও নামকথন:
এই বইটা কেনার আরো একটা বিশেষ কারণ হলো বইয়ের প্রচ্ছদ। বইয়ের প্রচ্ছদ যদি মনমতো না হয় তাহলে আমি বই পড়েও শান্তি পাইনা। প্রচ্ছদটা সাধারণের মাঝেও অসাধারণত্বে ভরপুর। বেশ সুন্দর ও সাবলীল। আর নামকরণ নিয়ে কী বলব। বইয়ের নাম ‘বউ সোহাগি’ কেন হলো সেটা জানার জন্য বেশ আগ্রহ হয়েছে। কিন্তু বইটা পড়তে শুরু করে কিছুতেই ক্যালকুলেশন করেও মিলাতে পারিনি কেন এই নাম দেয়া হয়েছে। যখন বইটা শেষ করলাম তখন বুঝতে পারলাম নামের রহস্য। বেশ আকর্ষণীয় নাম ও প্রচ্ছদ দিয়ে বইটি লেখা স্বার্থক হয়েছে লেখকের।
🔸ফ্ল্যাপ থেকে :
প্রথম দিকে ঘুমের ভান ধরে শুয়ে থাকলেও একটা সময় পর গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল শরৎ। বুনছিল হাজারও বাস্তব-অবাস্তব স্বপ্ন। সেই স্বপ্নে বিঘ্ন ঘটল কারও ক্রমাগত ধাক্কায়। শরৎ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। লাল চোখে বলল,
কী হয়েছে?
আফিয়াহ সেই চোখ দেখে ঘাবড়ে গেল। দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে বলল,
জরুরি কথা আছে।
শরৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হতবাক! এই রাতের বেলা ঘুম থেকে তুলে মেয়েটা তাকে বলছে, জরুরি কথা আছে। এটাই কি তার বিবাহ জীবনের প্রথম সূচনা সংখ্যা? শরৎ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীরে বলল,
কী কথা?
আসলে কথা নয়, একটা চাওয়া।
মানে?
আমার একটা অনুরোধ আছে আপনার কাছে।
শরৎ খেয়াল করল আফিয়া কাঁপছে। নাকের ডগা ও ওষ্ঠধরের উপরে ঘামের কণা জড়ো হচ্ছে। একটু একটু করে ওড়নার এক অংশ হাতে গুছিয়ে নিচ্ছে। শরৎ ঢোক গিলল। সংশয় নিয়ে বলল,
কী অনুরোধ?
আফিয়াহ সাথে সাথে উত্তর দিতে পারল না। এক ঝলক শরৎের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে। মনের সাথে হয়তো যুদ্ধ চালাচ্ছে। কঠিন যুদ্ধ! শরৎ ভয়ে ভয়ে পুনরায় বলল,
কী অনুরোধ?
আফিয়াহ শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে সাথে সাথে উত্তর দিল,
আমার একটা ঘর চাই।
শরৎ হকচকিয়ে গেল। অল্পক্ষণ ভাষা হারিয়ে বসে থাকল। সেকেন্ড কয়েক পর চকিত স্বরে বলল,
ঘর! কীসের ঘর?
আফিয়া এবার কেঁদে দিল। আচমকা শরৎের এক হাত চেপে ধরে কপালে ঠেকিয়ে বলল, আপনার সাথে থাকার মতো একটা ঘর। যে-কোনো ঘর হলেই চলবে। শুধু চারপাশে বেড়া থাকলেই হলো। আমার খাওয়া নিয়ে আপনার একটুও ভাবতে হবে না। পানি খেয়ে দিন কাটিয়ে দেব। ঘুমিয়ে রাত কাটিয়ে দেব। কথা দিচ্ছি, আপনার কোনো কিছুতে হস্তক্ষেপও করব না। আপনি না চাইলে আপনার দিকে চোখ তুলে তাকাব না পর্যন্ত। দেবেন আমায় একটা ঘর?
কাহিনী-সংক্ষেপ:
‘বউ সোহাগি’ বইটি ক্ষুৎপিপাসায় কাতর এক নারীকে নিয়ে লেখা। যার তনু-মনে সব সময় ভালোবাসার ক্ষুধা ও তৃষ্ণা প্রতীয়মান। সেই পিপাসা মেটাতে গিয়ে মেয়েটি তলিয়ে যায় এক মহাসমুদ্রে। তারপর! সমুদ্রের সেই নোনাপানি কি ভালোবাসার রঙে রাঙাতে পেরেছিল? নাকি কোনো এক অজানা ভয়াবহ ঢেউ তছনছ করে দেয় সবকিছু? নাকি ভালোবাসারা বন্দী হয়ে পড়ে নিকষকালো আঁধার কুঠরিতে!
বউ সোহাগি বইটি এক সারল্য ছেলেকে নিয়ে লেখা। যে হঠাৎ স্নেহের ডোর ছিঁড়ে ছিটকে পড়ে কঠিন বাস্তবতায়। মুখোমুখি হয় দুরূহ টানাপোড়েনে। এই টানাপোড়েনের সামাল দিতে দিতে বুকের কোথাও একটা সুখময় যন্ত্রণা টের পায়। শেষ পর্যন্ত কি সেই যন্ত্রণা সুখময়ই থেকে যায়? নাকি ভালোবাসার তীব্র দাহে হৃদয় থেকে পোড়া গন্ধ ছড়ায়! ‘বউ সোহাগি’ বইটি এক অভিমানী নারীকে নিয়ে লেখা। যার ধারণা, তার প্রিয় মানুষটি ভালোবাসা কুঁড়াতে গিয়ে ভালোবাসতেই ভুলে গেছে। ‘বউ সোহাগি’ বইটি এমন এক হৃদয়বানকে নিয়ে লেখা, যে ভালোবাসাকে হাসাতে গিয়ে বারবার কাঁদিয়ে ফেলে। এমনই গোটা কয়েক চরিত্র নিয়ে সম্পূর্ণ ‘বউ সোহাগি’। এ যেন সেই পরিচিত ভালোবাসার কিছু অপরিচিত অনুভূতি। পরিচিত জীবন প্রবাহকেই আরও একবার নতুনভাবে পড়ে ফেলা।
চরিত্র-কথন:
বউ সোহাগি উপন্যাসে ভুরি ভুরি চরিত্র নেই। তবে আবার কমও নয়। গোটা কয়েক চরিত্রকে নিয়েই পুরো উপন্যাসটি রচিত। কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছে শরৎ, বর্ষা, আফিয়াহ, মহসীন,তিনু, মোহন, রিতু সহ আরো কয়েকজন। প্রত্যেকটা চরিত্রই ভীষণ শক্তপোক্ত।
বর্ষা: মায়ের ভালোবাসা দানে এক অসাধারণ নারী। যে কীনা ভাই ও স্বামীর জন্য জীবন বিসর্জন দিতেও রাজি।
শরৎ: বোনের প্রতি অগাধ ভালোবাসায়, শ্রদ্ধাবোধ নিয়েই জীবন। অগোছালো, উদাসীন ছেলেটাকে আগলে রেখেছে দুই নারী সত্ত্বা। একসময় তার এই ছন্নছাড়া জীবনেও নেমে আসে ভালোবাসার ছোয়া।
আফিয়াহ: কখনো সরল, তো কখনো জটিল আবার কখনো ভালোবাসার কাঙাল। কখনোবা জেদের সুতো টানে। সবকিছুর পেছনেই একরাশ মুগ্ধতা কাজ করে।
তিনু: ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে তিনু। এক আকাশ পরিমাণ ভালোবাসতে জানে মেয়েটা।
মোহন: দায়িত্বশীল, সৎ ও ভালোবাসায় ভরপুর বিশ্বস্ত কর্মচারী। মালিককে অসম্ভব রকম ভালোবাসতে জানে। এছাড়াও আরো একজন বিশেষ মানুষকে সে ভালোবেসে আপন করে নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে সুখে।
মহসীন: বদমেজাজী, রুক্ষ ব্যবহারের এই চরিত্রটির পেছনেও লুকিয়ে আছে এক আকাশ পরিমাণ ভালোবাসা কিন্তু সেই ভালোবাসা সে কাউকে দেখাতে পারে না। লোকচক্ষুর আড়ালে একান্তই আড়াল করে রাখে নিজস্বত্তায়।
পাঠ-প্রতিক্রিয়া : বউ সোহাগি’ বইটি লেখকের দ্বিতীয় বই হলেও আমার পড়া প্রথম বই। প্রথম বই পড়া হিসেবে খুবই ভালো লেগেছে বইটি। লেখকের শব্দচয়ন, বর্ণনাভঙ্গি, লেখনশৈলী মাশাআল্লাহ খুব সুন্দর। ভূমিকা থেকে জানা যায় এটি লেখকের লেখা প্রথম উপন্যাস। অনেক আগের লেখা উপন্যাসটি ২০২১ সালে বই হিসেবে প্রলাশিত হয়৷
উপন্যাসটিতে বর্ষা ও শরৎের ভাইবোনের অগাধ ভালোবাসার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। পিতৃ-মাতৃহীন ভাইকে কী করে আগলে রাখতে হয় সেটা লেখক খুব সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন। এছাড়াও বইটিতে বিশেষ আকর্ষণ করেছে স্বামী-স্ত্রীর অপরিসীম ভালোবাসা, দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ।
ভাইবোনের সম্পর্কটা যে কতটা গভীর তা এই উপন্যাসে অনেকটা আন্দাজ করা যায়।একটা বোনের ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা। ভাইকে আগলে রাখা।ভাইবোনের মধুর সম্পর্কের সকল ধারা উপন্যাসটিতে প্রভাবিত হয়েছে।
একজন পাঠক এই বইটি যখন পড়বে তখন তার অনুভূতি হবে মিশ্র। রহস্য, রোমাঞ্চ, সামাজিক, মানসিক সব ধরনের অনুভূতিতে মোহোবিষ্ট হবে পাঠক। লেখক এই বইয়ের মাধ্যমে একটা মেসেজ পাঠককে দিতে চেয়েছে। জানিনা পাঠক তেমনভাবে খেয়াল করবে কী না।
তবে আমি নতুন কিছু জানলাম সাইকোলজি নিয়ে। এমনিতেও সাইকোলজি বিষয়ে আমার বেশ আগ্রহ আছে। সেই হিসেবে মেসেজটা মনে হলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমাজে অহরহই এমন ঘটনা ঘটে থাকে কিন্তু আমরা খালি চোখে সেটা দেখতে পাইনা। আমার মনে হয় মানুষ একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই এরকম সমস্যা ধরতে পারবে এবং সমাধানও করতে পারবে। পাঠকের প্রতি একটাই কথা থাকবে আপনি যদি বই পড়তে ভালোবাসেন তাহলে অবশ্যই এই বইটা পড়ে দেখতে পারেন।
🔸অন্যান্য দিক:
বর্ণলিপি প্রকাশনীর বই আমি আগে পড়েছি কী না মনে পড়ছে না। আমার মনে হচ্ছে এটাই আমার এই প্রকাশনীর পড়া প্রথম বই। বইয়ের প্রচ্ছদ, বাইন্ডিং, ও প্রকাশনায় বেশ ভালো রেটিং পাবে। বইয়ের লেখাগুলো অতি ক্ষুদ্র হওয়ায় বইয়ের পেজ সংখ্যা সীমিত হয়েছে। তবে লেখাগুলো আর অল্প একটু বড় হলে ভালো হতো। যাই হোক, বর্ণলিপি প্রকাশনীর অন্য বইয়ের সম্পাদনা কেমন হয়েছে জানা নেই। তবে এই বইয়ের সম্পাদনায় অনেক ঘাটতি রয়েছে। প্রচুর টাইপিং মিস্টেক রয়েছে, যেটা পড়তে গিয়ে বিরক্ত লেগেছে। প্রকাশনীর উচিত সম্পাদনায় আরো একটু বিশেষ খেয়াল রাখা। ভালো-খারাপ নিয়েই জীবন। তাই এতটুকু বাদ দিলে বইটা ভীষণ ভীষণ সুন্দর। আমার প্রিয় বইয়ের তালিকায় এই বইটিও যোগ হলো।
প্রিয়-উক্তি:
ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসতে না পারার কষ্টটা আমার থেকে ভালো কেউ বুঝবে না।
হয়তো তোমার মতো আমিও একদিন মাটির নিচে শুয়ে পড়ব। হারিয়ে যাব পৃথিবীর বুক থেকে। কিন্তু কাশফুল? শরৎ? এরা যুগ যুগ বেঁচে থাকবে প্রকৃতির সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে।
রেটিং ৯.৫/১০ – ছবি: কালেক্টেড
Leave a comment