বই রিলেটেট যতপ্রকার মিম ক্রিয়েট হয় তার সিংহভাগ জুড়ে হুমায়ূন আহমেদ থাকেন। তার প্রতি পাঠকের একটাই অভিযোগ যে, উনি উপন্যাসের এন্ডিং রাখেন না। আসলেই কি তাই?
একজন একনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে আমার কাছে মনে হয় হুমায়ূন আহমেদ যে তার উপন্যাসের এন্ডিং রাখেন না এটাই তার লেখার সবচেয়ে সুন্দর দিক। ছোটবেলা থেকেই হুমায়ূন আহমেদ আমাকে এভাবেই শিখিয়েছেন জীবন কতটা অনিশ্চিত।
‘অপেক্ষা’তে সুরাইয়ার ঘরের দরজায় যখন কলিংবেল বেজে উঠলো,কে এলো সেটা আর লেখক বললেন না। এই কারণে হাজারো পাঠকের হুমায়ূন আহমেদের ওপরে রাগ। কিন্তু ভেবে দেখুন যদি উনি বলে দিতে কে এসেছে? যদি দেখাতেন অন্য কেউ এসেছে কষ্ট কি আপনার বেশী হতো না? বা ‘হিমুর আছে জল’ এ যদি হিমুকে ডুবিয়ে মারতেন সিরিজের পরবর্তী গল্প আর কিভাবে লিখতেন তিনি? প্রশ্ন আসতো যে, হিমু তো মারাই গেছে তাহলে আবার লিখছেন কিভাবে তাকে নিয়ে? হুমায়ূন আহমেদ বারবার বলেছেন, তার উপন্যাসের শেষটা পাঠকের হাতে ছেড়ে দেন তিনি। এটা যে পাঠকের কল্পনাপ্রবণ মনের জন্য কতবড় একটা ছাড় বেশীরভাগ পাঠকই তা বোঝে না।
আমার খুব পছন্দের একটা এন্ডিং ‘বৃষ্টি বিলাস’ উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “শ্যামা একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” আমি ধরেই নিয়েছি শ্যামা চলে গেছে আতাউরের কাছে কারণ তার কাছে যাওয়াটাই তার জন্য সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত হতো। আশফাকের কাছে যাওয়াটা হতো স্বাভাবিক। আমার কাছে মনে হয়েছে অসমাপ্ত রেখেও লেখক একদম পরিস্কার বলে দিয়েছেন এন্ডিংটা। তারপরেও যারা অন্য কিছু ভাবতে চায় ভাবার সুযোগটা কেড়ে নেননি তাদের কাছ থেকে।
পরিষ্কার করে এন্ডিং লিখে দেয়া আছে হুমায়ূন আহমেদের এমন বই পড়েই বরং আমি হতাশ হয়েছি। আমার মনে হয়েছে,লেখক আমার কল্পনার ছাড়টুকু এখানে কেন দিলেন না? ‘মাতাল হাওয়া’তে নাদিয়ার যে পরিণতি হুমায়ূন আহমেদ করেছেন তারজন্য অনেকগুলো দিন আমি ডিপ্রেশনে ভুগেছি। বা ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসে উনি একটা অসমাপ্ত এন্ডিং রাখার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও লিখে ফেললেন, ”বাস্তবে নইমুলরা ফিরে আসে না।” এটাতেও আমি কম কষ্ট পাইনি।
শুধু আমিই কেন? পাঠক/দর্শক কেন আজ অব্দি ‘কোথাও কেউ নেই’ এর এন্ডিং মেনে নিতে পারে না? ওখানে তো পরিস্কার করে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি দিয়ে দিলো লেখক,তাও তো দর্শক রাগে রীতিমত মিছিল শুরু করেছিলো। এদিকে উনি যদি এটা অসমাপ্ত রাখতেন তখনও রেগে যেতো পাঠক।
‘শ্রাবন মেঘের দিন’ উপন্যাসে চমৎকার একটা অসমাপ্ত এন্ডিং রেখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। নৌকা রওনা হয়েছে,যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি চালিয়ে মতি চেষ্টা করছে ডাক্তারের নৌকা পর্যন্ত পৌঁছাবার। এখানেই শেষ। আমি ভেবে নিয়েছিলাম তারা ডাক্তারের নৌকা ধরতে পেরেছে,কুসুম বেঁচেছে,মতির সাথে তার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু লেখক যখন দেখলেন দর্শক পাঠকের মতো এত কল্পনাপ্রবণ না তখন তিনি শ্রাবন মেঘের দিন সিনেমাতে এন্ডিং দিয়ে দিলেন। কুসুমের মা বলে উঠলো, “মতি,নাও ফিরাইয়া লও”.. দর্শক তখন কেঁদেকেটে বললো, “হুমায়ূন আহমেদ নিষ্ঠুর! এইটা তিনি কি করলেন?” বা ঘেটুপুত্র কমলাতেও নিষ্ঠুর একটা এন্ডিং দর্শককে কম কাঁদায় নি। একইভাবে কৃষ্ণপক্ষ উপন্যাস,সিনেমা দুইটাই কাঁদিয়েছে। মেঘ বলেছে যাবো যাবো,রোদনভরা এ বসন্ত, লীলাবতীর মৃত্যু বইগুলোতে আবার হুমায়ূন আহমেদ দুইটা এন্ডিং দিয়েছেন,লেখকের কল্পনায় হ্যাপি এন্ডিং আর বাস্তবতা, যেটা স্যাড এন্ডিং।
আমার কাছে এগুলোও ভালো লেগেছে। গল্পে হ্যাপি এন্ডিং,স্যাড এন্ডিং তো দরকার আছেই। কিন্তু এই যে এন্ডিং ছাড়া শেষটা এটা ওনার একটা বিশেষত্ব,এটা হুমায়ূনী স্টাইল। পাঠকের হাতে শেষটা ছেড়ে দেয়া তার একটা ত্যাগ। কাউকে মেরে বা বাঁচিয়ে দিয়ে পাঠকের কাছে চরিত্রটাকে একেবারে শেষ করে দিতে তিনি চাননি। তিনি চেয়েছিলেন তারা বেঁচে থাক পাঠকের হৃদয়ে। পাঠক তার বয়স,অভিজ্ঞতা ইত্যাদি দিয়ে ভেবে নিক কি হয়েছিলো। ঠিক যেমন আমি একটা বয়সে ‘অপেক্ষা’ পড়ে ভেবেছিলাম সুরাইয়ার স্বামী ফিরে এসেছে কিন্তু ম্যাচিউর হবার পর আবার পড়ে ভেবে নিলাম আসেনি, কারণ বাস্তবে এতবছর পর একজনের ফিরে আসার সম্ভাবনা শুন্যের কোঠায়, উপন্যাসের নামটাও এতে পূর্ণতা পায় না। দুই ভাবেই ভাবতে পেরেছি আমি তাই এটাকে আমি অসমাপ্ত বলতে পারি না। এটা আমার কাছে স্যাটিসফেকশন। উপন্যাস এভাবেই সাকসেসফুল করতে হয়,তাইতো ‘অপেক্ষা’ নিয়ে এতবছর পরেও এত আলোচনা,পাঠকের এত প্রিয় উপন্যাস এটা। আমি জানি না সুরাইয়ার স্বামী ফিরে এলো কি এলো না সরাসরি লেখক বলে দিলে এটা হতো কিনা।
আসলে হুমায়ূন আহমেদের একটা,দুইটা বই পড়ে আপনি সেগুলোকে অসমাপ্ত বলতে পারেন না,তার বই পড়ার অভ্যাস করে ফেললে এই অসমাপ্তি আপনাকে সবচেয়ে বেশী স্বস্তি দেবে। কারণ তখন হুমায়ূন আহমেদ আর কাউকে মেরে ফেলতে পারছেন না,শেষ সুতো খেলাবেন আপনি। আপনি আপনার পছন্দের চরিত্রকে বাঁচিয়ে দেবেন, লেখক সেই স্বাধীনতা আপনাকে দিয়ে গিয়েছেন।
Jannatul Firdous
Leave a comment