Post ID 111476
বইঃ হজ্জ আমাদের কী শেখায়
লেখকঃ ড. আলী শরিয়তী
অনুবাদকঃ মুন্সী মোহাম্মদ রফিকুল হাসান
প্রকাশকঃ ডন পাবলিশার্স
প্রকাশকালঃ ১৯৯৬
মুদ্রিত মূল্যঃ ৬০ টাকা
পৃষ্ঠাঃ মোট ১৬০ পৃষ্ঠা।
__________________________________________
হজ্জ। রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খিলাফতের দায়িত্ব পালনের উচ্চতর প্রশিক্ষণ।
আপনি প্রশিক্ষণ নিয়ে কতটা নিজেকে উপযুক্ত প্রমাণ করবেন তা নির্ভর করছে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির উপর। আপনি হজ্জের মতো উচ্চতর প্রশিক্ষণকে অন্য দশজনের চেয়ে আলাদা করে দেখতে পারছেন কি? যেভাবে দেখেছেন সাহাবায়ে কেরাম, সালফে সালেহীন।
যেমন দেখেছেন ড. আলী শরিয়তী।
“হজ্জ আমাদের কী শেখায়” (the hajj) বইতে নিজের প্রশিক্ষণের চমৎকার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন ড.আলী শরিয়তী।
লেখককে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের তাত্ত্বিক রূপকার বলা হয়। বিশ্বব্যাপী ইসলামী বিপ্লবের প্রস্তুতিমূলক বিপ্লবীদের প্রস্তুত করার দারুণ প্রশিক্ষণ হজ্জ। এ বইতে লেখক সে বিষয়ে আলোকপাত করে বইয়ের যবনিকাপাত করেছেন।
উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটাছুটি কিংবা পাথরের মূর্তিতে অর্থহীন পাথর ছোঁড়ার নাম হজ্জ নয়। হজ্জ সুফিবাদের কোনো বিশ্ব সম্মিলন নয়। এ সম্মেলন মর্দে মুজাহিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
লেখকের মতে “আদমকে সৃষ্টি করার পেছনে যে দর্শন কাজ করেছে হজ্জ হলো তার বহিঃপ্রকাশ। ” “হজ্জ পালনের পুরা অনুষ্ঠানটা হলো একই সঙ্গে অনেক কিছুর মঞ্চায়ন…যেমন “সৃষ্টির মঞ্চায়ন”, ” ইতিহাসের মঞ্চায়ন”, ইসলামী আদর্শের মঞ্চায়ন, ইসলামী উম্মাহর মঞ্চায়ন।
স্বয়ং আল্লাহর মঞ্চ ব্যবস্থাপনায় আপনি নিজেই অভিনয় করছেন আদম (আ), ইব্রাহীম (আ) ও হাযর (আ) এর ভূমিকায়। প্রেক্ষিত আল্লাহ তায়ালা ও শয়তানের দ্বন্দ্ব।
এখানে আপনি পৌণঃপুণিক দোলকগতির মতো লক্ষ্যহীন জীবন দোলাচলের অন্তঃসারশূণ্য দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করছেন। প্রত্যাখ্যান করছেন এতদিনকার আপনার “বেঁচে থাকাই বেঁচে থাকার যে চূড়ান্ত লক্ষ্য” ছিলো তাকে।
জীবনের বিষচক্র আপনাকে আপনার খিলাফতের আসল দায়িত্ব ও মনুষ্যত্বের আসল স্বভাব থেকে দূরে সরিয়ে ফেলেছে। আপনার ভেতর সৃষ্টি করেছে “নেকড়ে”, “শিয়াল”, “ইঁদুর” আর “ভেড়া” র স্বভাব। লেখক মনে করেন আপনি আল্লাহর সমীপে হাজির হয়ে আপনার “আত্মহীন জড় মানব থেকে আবার জেগে উঠবেন আল্লাহ তায়ালার রূহানী শক্তিতে। প্রত্যক্ষ করবেন আল্লাহকে। “
সংশোধনাগার থেকে বিচারালয়ের জন্য প্রস্তুতি নেবেন। মহড়া দিবেন” মৃত্যুর আগে আরেকবার মৃত্যুর “।
বিপ্লবী লেখক মনে করেন,
“ফানাফিল্লাহর” মতো ভণ্ডামি নয়, “আল্লাহর কাছে যাওয়ার”, “শেষ”হওয়ার নয় বরং ” “প্রস্ফুটিত” হওয়ার দর্শন শিক্ষা নিবেন এই মঞ্চ থেকে।
এসব দর্শন নিয়ে ক্ষমতার প্রাসাদ থেকে, ধন-সম্পদের ভান্ডার থেকে, বিপথে পরিচালনাকারী মন্দিরসমূহ থেকে মুক্ত হয়ে মি’কাতে প্রবেশ করবেন আপনি। আপনি এখন অভিনয় শুরু করবেন। নির্দিষ্ট ড্রেসাপ-মেকাপ নিতে হবে এখান থেকেই। খুলে ফেলুন “আমিত্বের” পোশাক। জনতার কাতারে সামিল হয়ে “সাধারণের পোশাক” পরিধান করুন। “আমি” নয় “আমরা” হয়ে যান।
“অজ্ঞতা” “অবহেলা”র জীবন থেকে আল্লাহ সম্পর্কে সত্যিকার অর্থে ” সচেতন ” হয়ে উঠুন। খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসুন খেজুর বৃক্ষের মতো খেজুর দানা থেকে। নিয়ত করুন। আর মি’কাতে প্রার্থনা করুন, ইইব্রাহীমের মতো প্রবল বিদ্রোহের ঘোষণা দিন। হে আল্লাহ, ” আমি আর মূর্তি পূজা করিনা, আমি আর নমরুদের এবাদত করিনা।” হে আল্লাহ, আমি আপনার সামনে উপস্থিত হয়েছি- ইব্রাহীম (আ) এর মত, নির্যাতনকারী নেকড়ের মত নয়, প্রতারক শৃগালের মত নয়, মজুতদার ইঁদুরের মত নয়, তাবেদার ভেড়ার মত নয়। উপস্থিত হয়েছি “মানুষ” হিসেবে।
কী চমৎকার দৃশ্যের অবতারণা করছেন ড. আলী শরিয়তী! আপনার অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিতে কী চমৎকার দর্শন হাজির করছেন আপনার সামনে ভাবুনতো। লেখক মনে করেন, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে মসজিদুল হারামের দিকে নেমে আসার দৃশ্য মানবজাতির ভাগ্যের প্রতি ঈঙ্গিত দিচ্ছে। এই প্রতীকী ঘটনার অর্থ হলো মানুষ ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাবে(অর্থাৎ কবরে প্রবেশ করবে) এবং এভাবেই সে আল্লাহর কাছে উত্থিত হবে হাশরের ময়দানে।
আপনি এগুলেন কাবার চত্তরে। আপনি এখন মুক্ত। শাসক ও নিপীড়নকারীর বশ্যতা মুক্ত। মক্কার কোনো নিয়ন্ত্রক নেই। আল্লাহ এর মালিক আর জনতা এর অধিবাসী। এখানে আপনার কসর নেই। নামাজ পুরো আদায় করবেন। কারণ এটা আপনার বাড়ি।
লক্ষ্য করুন, একজন নিগ্রো দাসী হাযেরার কবর। ইতিহাসের মঞ্চায়ন। ইথিওপীয় একজন নারী! আল্লাহ যাকে অধিষ্ঠিত করেছেন মর্যাদার স্বর্ন শিখরে। আল্লাহ বেছে নিয়েছেন এভাবে,
সমস্ত মানবজাতির মধ্যেঃ একজন নারী
সমস্ত নারীজাতির মধ্যে ঃ একজন দাসী
এবং সমস্ত দাসীদের মধ্যে একজন কৃষ্ণাঙ্গিনী।
কাবার চারপাশে তাওয়াফের মাধ্যমে আপনি লাভ করবেন এক নতুন দর্শন। যে দর্শনে কপটতা, শঠতা ভাববাদের নামে ভণ্ডামি নেই। আছে প্রকৃত জীবনের স্বাদ। সেই স্বাদ আস্বাদনের ব্যাপারে ক্ষণজন্মা লেখকের দৃষ্টি সুতীক্ষ্ণ।
আল্লাহর পথ তথা জনতার পথে নামার উদাত্ত আহ্বান তাওয়াফ। তাওয়াফ উত্তাল গর্জনশীল সমুদ্রের মত। জনতার সমস্যা থেকে বিমুখ হয়ে অতিকায় সাধু সেজে মঠে গিয়ে মুক্তি খোঁজার মধ্যে মুক্তি নেই। মুক্তি খোঁজার পথ সমস্যা মোকাবেলা করতে মাঠে নামার মধ্যে। আমার মতে “মঠ” ও “মাঠ” শব্দ দুটিতে স্বর চিহ্নের পার্থক্য নয়। এই একটি আকার মানেই যুদ্ধাস্ত্র, লড়াইয়ের হাতিয়ার, পারমাণবিক বোমা।
হাযরে আসওয়াদ থেকে আনুগত্যের শপথ নিয়ে তাওয়াফ করুন।অত:পর নিজেকে আবিষ্কার করুন মাকামে ইব্রাহীমে। ইব্রাহীমের মত অসত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে, খোদায়ীর দাবিদার শয়তান নমরুদের বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহ করতে আর এই পথের বাঁধা প্রিয় ইসমাইলকে কুরবানী করতে সংকল্প করুন।
এবার আপনি অভিনয় করবেন হাযেরার ভূমিকায়। পরিবর্তনের জন্য তাওয়াফের মত একই আবর্তে না ঘুরে এবার প্রাণান্ত চেষ্টা করুন। দৌঁড়াতে থাকুন। আল্লাহর প্রেম নিয়ে নৈরাশ্যবাদীর মত বসে না থেকে খুঁজতে থাকুন জীবনোপকরণ। এর নাম সা’ঈ।
তাওয়াফ ও সা’ঈ র পার্থক্য করতে গিয়ে লেখক উপমা দিয়েছেন প্রজাপতি ও ঈগল দ্বারা। কি আশ্চর্য উদাহরণ!
লেখক বলেন,
“তাওয়াফঃ প্রদীপের চারদিকে ঘুরে মরা প্রজাপতির মত, বাতাসে যার ভস্ম উড়ে যায়। যে প্রজাপতি হারিয়ে যায় প্রেমে,মৃত্যুবরণ করে আলোয়।”
সায়ঈঃ নিজের শক্ত ডানায় ভর করে কালো পাহাড়ের ঊর্ধ্বদেশে উড়ে বেড়ায় যে ঈগল খাদ্য খুঁজে আর পাথরের খাঁজ থেকে ছিনিয়ে নেয় নিজের শিকার। এ ঈগল পৃথিবী ও আকাশ দু’টোই জয় করে। বাতাস বয়ে যায় পৃথিবীতে, আকাশে। আকাশে মুক্তগতি ঈগল, স্বর্গ হলো তার অভীষ্ট। তার ডানার নিচে এ পৃথিবী তুচ্ছ।
এভাবেই দুনিয়ার তাবৎ ভাববাদ, সুফিয়ানাকে মাটিচাপা দিয়েছেন লেখক। ভাববাদ না বস্তুবাদ? ইহকাল না পরকাল? ভোগবাদ না কৃচ্ছতানীতি? যুগ যুগ ধরে চলমান মানুষের অন্তর্দ্বন্দের সমাধান হলো হজ্জ। হজ্জ হলো তাওয়াফ আর সায়ঈর সমন্বয়। ইসলামের সার্থকতা এই সমন্বায়নের মধ্যেই নিহিত।
সমন্বয়ের পর এবার ছুটে চলুন নিজের “ইসমাঈলের” সন্ধানে, আল্লাহকে পাওয়ার জন্য আপনি যাকে কুরবানী(বিসর্জন) দিবেন। এবার অভিনয় করতে হবে নাটকের ক্লাইমেক্সে। মূল অঙ্কে। শুরু হলো হজ্জ। এতদিন? তা ছিলো ওমরাহ।
মক্কার চারপাশে প্রেম না খুঁজে প্রেম পাওয়ার জন্য পরীক্ষা দেয়া শুরু করুন। সাঈর পর খুলে ফেলা ইহরাম আবার পরুন।
ছুটে যাবেন আরাফাতে। জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জন করুন এখানে। মানব সৃষ্টির ইতিহাসের মঞ্চায়ন এখানে। আরাফাতের উজ্জ্বল সূর্যের নীচে নিজের অহংকে পুড়িয়ে দিন।
এবার উপনীত হোন মাশয়ারে(মুজদালিফায়)। এখান অন্ধকার। পথ হারাবেন না। “সচেতন” হোন। ন্যায়ের পথে নিজেকে উৎসর্গ করুন। এতেই মুক্তি। এটাই প্রকৃত ইবাদত। জ্ঞান ও সচেতনতার অভাবনীয় পার্থক্য দেখিয়েছেন লেখক।
এখানেই অস্ত্র খুঁজুন।অন্ধকারের মধ্যে। প্রতিকূল পরিবেশের দোহাই নয়, প্রতিকূল পরিবেশেই বিপ্লবের রসদ সংগ্রহ করতে হবে।
সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই লড়াই শুরু মিনাতে। দিনের আলোতেই শত্রুর মোকাবিলা করবেন।
এখানে আপনাকে যুদ্ধ করতে হবে ত্রিত্বের বিরুদ্ধে। এই ত্রিত্ব কী?
মিনায় তিনদিনে আপনি ৪৯ টি গুলি করবেন। কাকে করবেন? কেন করবেন? বর্তমানের সাথে ইতিহাসের পাতা মেলাবেন। কোন সে ইতিহাস? হাবিল কাবিল। কার সাথে আপনার শত্রুতা কার সাথে মিত্রতা। চমৎকার বর্ণনায় ফুটে উঠেছে এসব অত্যন্ত বিশদভাবে।
চিনে নিতে পারবেন আপনার সমাজের ফেরাউন, কারুন আর বালাম কারা? কাকে আপনি প্রথম দিনেই আঘাত করবেন? এমন রণকৌশল শিখতে পারবেন যা শিখতে পারেননি “আর্ট অব ওয়ার” থেকে।
আপনার ইসমাঈল কে? আপনি কাকে কুরবানী দিবেন তাও জানা যাবে এই বইতে।
বিজ্ঞান আর ধর্ম, ধর্ম আর মানবতা, ভাববাদ আর বস্তুবাদ, পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের, গণতন্ত্র আর একনায়কতন্ত্র, পাদ্রী আর সম্রাট, মঠ আর মাঠ, যাজক আর ইমাম, সাম্রাজ্যবাদ আর খিলাফত সবার মুখোশ আপনার সামনে আপনা থেকেই খসে পড়বে যদি আপনি এই বইয়ের পাতাগুলো যত্নের সাথে উল্টাতে পারেন।
আপনার, আপনার সমাজের, রাষ্ট্রের, উম্মাহর সর্বোপরি মানবতার শত্রুকে চিহ্নিত করতে পারবেন অনায়াসেই। তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শান্তির বিশ্ব গড়তে মন্ত্র পাবেন এই বইতে। যা বিপ্লবী লেখকের হজ্জ নামক উচ্চতর প্রশিক্ষণের অনুভূতি।
বইটি আপনার জন্য অবশ্য পাঠ্য, যদি আপনি দর্শন পড়তে পছন্দ করেন। দর্শনের সমগ্র জগৎ যেখানে নিরস ও শুষ্ক হয়ে গেছে সেখানে আপনি এই বইটি পাঠে পাবেন জীবন সঞ্জীবনী উত্তাল স্রোতে বয়ে চলা সদা জাগ্রত এক দর্শনসমুদ্র।
রিভিউ লেখক- স্বাধীন মুরশিদ
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?