বই : পথের পাঁচালী
লেখক : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশ : ১৯২৯ ইশায়ী
বাংলা সাহিত্যে বিভূতিভূষণের আগমন আকস্মিক ও বিস্ময়কর। দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণে বিভূতিভূষণ মানব জীবনকে বেঁধেছেন প্রকৃতির সাথে। শিশু মনের দুৰ্জেয় রহস্যময়তা, শৈথিল্যহীন আবিষ্কারের নেশা, নতুনকে জানার ব্যাকুলতা ‘পথের পাঁচালী’র নায়ক অপুর মাধ্যমে তিনি যেভাবে দেখিয়েছেন, বাংলা সাহিত্যে তার দ্বিতীয় নজির নেই। গদবাঁধা জীবনের নানান জটিলতা, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, নরনারীর প্রেম-মিলন-বিরহ, সামাজিক-পারিবারিক সংঘাত-সংঘর্ষ, সামাজিক অবক্ষয়, রাজনীতি এতসব উপাদানকে উপেক্ষা করে পথের পাঁচালী উপন্যাসটি ফুটিয়ে তুলেছে সহজ-সরল ও আনন্দ-দুঃখের মায়াজালে আবৃত পল্লী-জীবনের কিছু চরম সত্য-বাস্তবতা। পল্লীপ্রকৃতি, দিগন্তস্পর্শী অরণ্য, আকাশের হাতছানি পাঠককে নিয়ে যায় স্বপ্নের অমরাবতীতে। প্রকৃতি বিভূতিভূষণের কাছে জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। এতে কোনো কাব্যময়তা নেই, কিন্তু আছে অদ্ভূত ছন্দময়তা। যে সামাজিক প্রেক্ষাপটে গোটা উপন্যাসটি রূপায়িত, তার ব্যাপ্তি যেন কেবল প্রতি যুগের সাক্ষী শাশ্বত ঘটনাবলীতে নয়। চিরায়ত বাংলার সমস্ত রূপ রসই এই উপন্যাসের মনোমুগ্ধতার আধার। রাংচিতা, গুড়কলমী, রঙিন মাকাল ফল, ঘেঁটু, সোঁদালী, লেবু ফুলের মিষ্টি গন্ধ, গ্রাম্য বধূর ভিজে পায়ের ছাপ, কাশবন, পদ্মঝিল, দুই কিশোর-কিশোরীর দুরন্তপনা, অপার বিস্ময় আর তাদের অনুসন্ধিৎসু চোখের অবাক করা নিশ্চুপ দৃষ্টি উপন্যাসটিকে অধিক সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে। সে নিশ্চুপ দৃষ্টির ভাষা যেন শব্দের চেয়েও জোরে কথা বলে! আর সেই ছবি শিল্পীর তুলিতে বিভূতিভূষণ এঁকেছেন ঠিক নির্ভুলভাবে। দূর অতীতের সাথে পল্লীবাংলার জীবনের গ্রামীণ যোগ দিয়ে শুরু হওয়া উপন্যাসটির বর্ণনা ধীর। কাহিনীতে আচমকা চমক আনায় । বইটি পড়ে এমন কেউ নেই যে প্রকৃতির প্রেমে পড়বে না। সাধারণ একটা দৃশ্যেরও অসাধারণ বর্ণনা করেছেন লেখক। একই সাথে ভালোলাগা আর হৃদয়ে রক্তক্ষরণের অনুভূতি দেয় ‘পথের পাঁচালী’। বইটা সবসময় আমার কাছে ‘কষ্টে মোড়ানো ভালোবাসা’ হয়ে থাকবে।
উপন্যাসের ৮ম পরিচ্ছেদটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এর নবম-দশম শ্রেণির ‘মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্য’ সংকলনে ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ শিরোনামে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
Leave a comment