কাজী আনোয়ার হোসেন। নিছক কোন নাম নয় এটি। এই নামের পিছনের ব্যক্তি যেন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। স্বাধিনতার আগে এবং পরে লোভনীয় ক্যারিয়ার গঠনের দিকে না গিয়ে প্রকাশনা শিল্পের দিকে পা বাড়িয়েছিলেন তিনি। বিদেশী ধ্রুপদী সাহিত্যের অনুবাদ, হরর, ফ্যান্টাসি, থ্রিলার, রোমান্টিক, সায়েন্স ফিকশনের মত জঁরাকে ঘরে ঘরে পাঠিয়ে দেয়ার পিছনে মূল অনুঘটকের কাজ করেছেন আমাদের কাজীদা। তাঁর প্রকাশনার সাথে কাজ করেছেন অনেকে যারা পরবর্তীতে বিখ্যাত এবং খ্যাতিমানে পরিণত হন। প্রকাশনা ব্যবসায়ে তৎকালীন সফলতার কারণে আমার মতে তাকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম উদ্দ্যোক্তা বলা যায়।
পঞ্চরোমাঞ্চ। সত্তুরের দশকে সাড়া ফেলে দেয়া কাজী আনোয়ার হোসেনের লিখা পাঁচটি গল্প। অবশ্য এই সকল গল্প বিদেশি আখ্যানের ছায়ায় লেখা হয়েছিল। ১৯৭৫ সনে ঐ বইয়ে সেবা প্রকাশনীর ‘ঋণ স্বীকার’ থেকে তা জানা যায়।
পঞ্চরোমাঞ্চ অবলম্বনে কমিক্স সংকলন করার চিন্তা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছিল। তিনি শিল্পী হাশেম খানের সাথে এই বিষয়ে আলাপও করেছিলেন। তবে সম্পাদক সাহেবের যে নিজেরও শিল্পী হওয়া দরকার এরকম সংকলনকে কমিক বুকের রূপ দিতে তা বুঝতে পেরে কাজীদা আর এগিয়ে যান নি। সেবার একসময়ের কোলাজ প্রচ্ছদ করা হাসান খুরশীদ রুমী সমন্বয়কের এবং ঢাকা কমিক্সের সম্পাদক ও প্রকাশক মেহেদী হকের প্রাথমিক উদ্যোগে কাজীদার অনুমতি এবং সন্তুষ্টি সাপেক্ষে এই কমিক্স সংকলনের কাজ শুরু হয়ে যায়।
পঞ্চরোমাঞ্চ। পাঁচটি গল্প। পাঁচজন ভিন্ন কমিক্স শিল্পী। যে দুর্দান্ত কাজ এই শিল্পীরা করেছেন, সেই সময়ে এই কাজ করার জন্য তাদের মার্ভেল কমিক্সের অনুকরণে “দ্য ফ্যান্টাস্টিক ফাইভ” বলা যায়। এই সংকলনে এক্সেলেন্স দেখাতে না পারলে সব আর্টিস্টদের জন্য বিব্রতকর এবং ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হত। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হল আঁকিয়েরা হতাশ তো করেন নি বরঞ্চ সূচনা করেছেন আধুনিক বাংলা কমিক্সের এক উজ্জল ইতিহাস।
১) অন্য কোনখানে – শিল্পী : আরাফাত করিম
পুনরাবৃত্তিতে ভর্তি, উৎকন্ঠা, ভয়, অবসাদ এবং বিষন্নতায় ভুগা এক যুবক সবকিছু ছেড়েছুড়ে কোথাও চলে যেতে চায়। চায়ের দোকানে এক আধমাতালের কাছে শুনা গল্পের উপর ভিত্তি করে মুক্তির উদ্দেশ্যে সে হাজির হয় ‘ড্রিম ট্র্যাভেল এজেন্সি’ এর দরজায়। অনেক কৌশল এবং লুকোছাপা করে এগুতে হবে তাকে। তবে সে যেতে পারবে ‘অন্য কোনখানে’, এক ইউটোপিয়ান বিশ্বে। গল্পের সাথে সমান্তরালে এত যথাযথ অঙ্কন আসলে কমই দেখা যায়। পুরো স্টোরিতে আছে বিষন্নতার সাথে সাথে এক চাপা উত্তেজনার মিথস্ক্রিয়া।
২) ঝামেলা – শিল্পী : আসিফুর রহমান
বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়াল প্রাক্কালে এক পরিবার দেশ ছেড়ে আরেক দেশে আশ্রয় নেয়। স্বৈরাচার শাসিত সেই দেশের একনায়কের কাছে সন্দেহের পাত্র হয়ে কারাগারে চলে যান প্রায় সবাই। তবে রাতারাতি ইউরেনিয়ামের খাম্বা কিভাবে তৈরি হল? ঐ পরিবারের কি এমন কোন বিশেষত্ব আছে যা চোখে পড়ার মত। আঁকাআঁকির মাধ্যমে কোন গল্পের অনেক চরিত্র এবং তাদের মধ্যকার কোন রহস্য লুকোনো সহজ বিষয় নয়। পরিশ্রমী শিল্পী তা-ই করেছেন চমৎকার অঙ্কনের মাধ্যমে।
৩) ক্যান্সার – শিল্পী : মেহেদী হক
ক্যান্সার আক্রান্ত ইমরানের হাতে আছে আর মাত্র সাতদিন। নিজের প্রায় ওষ্ঠাগত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একজনের প্রাণ রক্ষা করেন ইমরান। এরপর তাঁর জীবন পাল্টাতে থাকে। এমনভাবে এইসব পরিবর্তন আসে যা তাঁর যুক্তি এবং কল্পনাকেও হার মানিয়ে দেয়। এই আখ্যানেও রহস্য আছে। আছে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুপ্ত করার ব্যাপার। গতিময় এই গল্পে সুন্দর অঙ্কনের মাধ্যমে শিল্পী সেই দারুন কাজটি-ই করেছেন।
৪) ওস্তাদ – শিল্পী : সাদী ইমদাদ
সবাইকে ঘোল খাইয়ে দেয়া ধুরন্ধর অপরাধী রুস্তম শেখের সাথে বাংলাদেশের সেরা গোয়েন্দা আব্বাস বা বাঘা মির্জার দ্বৈরথের গল্প অঙ্কন করেছেন সাদী ইমদাদ। গতানুগতিক স্টাইলের বাইরে অন্যরকমের শিল্পী সাদীর বিগ ফ্যান আমি। কারণ কমিক্সে মানুষের ইম্পারফ্যাকশান গুলো সাদী কেমন অদ্ভুতভাবে ফুটিয়ে তুলেন। রুস্তম শেখকে কি ধরতে পারবে আব্বাস মির্জা? গল্পে দারুন এক চমক আছে অবশ্য। দেখা যাক কে হয় কার ওস্তাদ।
৫) পরকীয়া – শিল্পী : তৌহিদুল ইকবাল সম্পদ
‘দুর্জয়’ এবং ‘মারুফ’ এর মত কাজের কারণে বাংলাদেশের কমিক্স প্রেমিদের জন্য এক হাইজহোল্ড নেইম তৌহিদুল ইসলাম সম্পদ। মুভিস্টার সাজ্জাদ এবং গৃহবধু নায়লার পরকীয়ার গল্পটির আর্টওয়ার্ক বেশ কঠিন ছিল যা পাঠক কমিক্সটি দেখলে বুঝতে পারবেন। নায়লার মাতাল স্বামী অজ্ঞান। সাজ্জাদ চট্টগ্রামে বসে প্ল্যান সাজায় মামুনকে হত্যা করার, চট্টগ্রামে বসেই। তাঁর দরকার নায়লার সাহায্য। দারুন প্রফেশলানিজমের সাথে আঁকিয়ের কাজ করেছেন সম্পদ।
এই বই বাংলা কমিক্সের জগতে একটি ঐতিহাসিক কাজ হয়েছে। কে, কার চেয়ে ভালো অঙ্কন করেছেন বলা খুবই কঠিন। প্রত্যেকের শিল্পীর কাজই ব্রিলিয়ান্ট হয়েছে। তবে পক্ষপাত তো খানিকটা কাজ করে। ‘অন্য কোনখানে’ এর কমিক্স রূপান্তর করেছেন আরাফাত করিম। আমার কাছে তাঁর আর্টওয়ার্ক সবচেয়ে ভালো লেগেছে। আরেকটি বিষয় খুব ভালো লেগেছে সেটি হল সুন্দর হাতের লিখার মত ফন্ট। প্রত্যেক গল্পের শুরুতে এক বা দুই লাইনে সেই গল্পের কোন বার্তা বা অংশ চিত্রন দারুন হয়েছে। ঢাকা কমিক্সের প্রতি অনুরোধ রইল আরো কৃতি ব্যক্তিদের কাজ নিয়ে সম্ভব হলে কমিক্স সংকলন করার।
কাজী আনোয়ার হোসেন আমাদের জীবনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছেন, রেখে আসছেন এবং মনে হয় আসবেন। আজ যে অনেক খ্যাতিমান এবং বিখ্যাত সমসাময়িকদের লেখালেখি এবং আর্ট, থ্রিলার এবং কমিক্সের যে অগ্রযাত্রা এমনকি এই যে আমার নিজের প্রোফাইল বা যেকোন গ্রুপে বুক রিভিউ লিখা তার পিছনে কাজীদার অবদান অস্বীকার করা যায় না। ঢাকা কমিক্স তাঁর গ্রন্থের সার্থক কমিক্স রূপান্তর করেছে।
কাজীদার কারণে অনেক রোমাঞ্চ ঘরে ঘরে প্রবেশ করেছে। এই কমিক্স রূপান্তরের মাধ্যমে গল্প এবং অঙ্কনের কমিক বুক ফরম্যাটে সমান্তরালে হাজির হয়েছে পঞ্চরোমাঞ্চ।
বুক রিভিউ
পঞ্চরোমাঞ্চ
লেখক : কাজী আনোয়ার হোসেন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মেহেদী হক
সার্বিক তত্ত্বাবধান : হাসান খুরশীদ রুমী
কমিক্স রূপান্তর :
আরাফাত করিম
আসিফুর রহমান
তৌহিদুল ইসলাম সম্পদ
মেহেদী হক
শেখ সাদী
সহযোগী সম্পাদক : নাসরিন সুলতানা মিতু
সহকারী সম্পাদক : আসিফুর রহমান
চিফ আর্টিস্ট : আরাফাত করিম
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : চৌধুরী ফরিদ
গ্রাফিক ডিজাইন : মাহবুব খান
প্রেস ও প্রডাকশন : প্রতিশ্রুতি প্রেস
অন্যতম পরিবেশক : সেবা প্রকাশনী
জঁরা : কমিক্স সংকলন
রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ
Leave a comment