গল্প:-নীল আকাশের ফিরে আসা-আলমগীর জনি
মুনিমের সাথে যখন আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল ঠিক ঐ সময়েই বড় আপার ডিভোর্স নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল আমাদের বাসায়।
আমাদের বাসা যদি একটা নদী হয় সে নদীর এক পাড় ভেঙে ছারখার হওয়ার উপক্রম আর আরেক পাড়ে আমার বিয়ের জন্য বিশাল উদযাপনের প্রস্তুতি। একটা নদীর এক পাড় ভাঙতে থাকলে সে নদী কখনোই ভালো থাকে না। তাই আমাদের বাসায় আপাতত কেউই ভালো নেই।
মুনিমের সাথে আমার এরেঞ্জড ম্যারেজ হচ্ছে। অবশ্য বড় আপা আর শফিক ভাইয়ের বিয়েটাও ছিল এরেঞ্জড ম্যারেজ।বড় মামার এক বন্ধুর খুব কাছের আত্মীয় শফিক ভাই। পাত্র একটা প্রাইভেট ফার্মে বড় পোস্টে জব করে, সিক্স ডিজিট স্যালারি ! সুতরাং এমন পাত্র হাতছাড়া করা যাবে না।বড় মামা তো আর উনার ভাগ্নির জন্য খারাপ পাত্র নিয়ে আসবেন না! তাই খুব বেশিদিন অপেক্ষা না করে খুব দ্রুতই বড় আপার বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়।
বড় আপার বিয়েটা আমার এইচ এস সি পরীক্ষার কিছুদিন আগেই হয়। তাই খুব বেশি সময় নেয়া বা খুব বড় করে অনুষ্ঠান করার সুযোগ ছিল না। শফিক ভাই যদিও চেয়েছিলেন একমাত্র শালীর জন্য পরীক্ষার পরেই বিয়েটা হোক। কিন্তু মুরুব্বীদের এক কথা , শুভ কাজে দেরি করতে নেই। ব্যস , শুভ কাজটা আগেভাগেই হয়ে গিয়েছিল।
আমি বলি কি, শুভ কাজের জন্যই সময় নেয়া উচিত। শুভ কাজটা শুভ হচ্ছে কিনা সেটা যাচাই করা উচিত। অশুভ কাজের বেলায় অপেক্ষা করার তেমন একটা প্রয়োজন নাই। এক কোটি বছর পরও অশুভ কাজটা অশুভই থেকে যাবে।
আমার কাছে মনে হয় একটু অপেক্ষা করলে বড় আপা আর শফিক ভাইকে আজকে এই অশুভ চিন্তা করতে হতো না। দুঃখের বিষয় হল বড় আপা আর শফিক ভাই দুইজনেই ডিভোর্সের ব্যাপারে এক পায়ে দাঁড়ানো।
গত তিন মাস শফিক ভাই একবারও বড় আপাকে ফোন দেন নি। এমন না যে বড় আপা বেশ কয়বার ফোন দিয়েছিলেন। বড় আপাও দেন নি। শফিক ভাই কিছুদিন আগে বিয়ের ঘটক বড় মামাকে জানিয়ে দিয়েছেন তার ফাইনাল সিদ্ধান্ত। তাও এমন এক সময়ে জানিয়েছেন যখন আমার বিয়ের তারিখটাও চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। যদিও বড় মামা শফিক ভাইকে আমার বিয়ের সময়টা পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরতে বলেছেন।
আমি অবশ্য আগেই আঁচ করতে পেরেছিলাম এমন কিছু। তবে ব্যাপারটা ছাড়াছাড়ির পর্যায়ে চলে যাবে তা কখনোই ভাবি নি।এদিকে আব্বা-আম্মা সমাজে কীভাবে মুখ দেখাবে সেই আশঙ্কায় দিন পার করছেন।বড় আপার চিন্তায় আম্মার বয়স ১০ বছর বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। বাড়বে না কেন? এই পৃথিবীতে সন্তানের দুঃখে কাঁদে না এমন মা কি পাওয়া যাবে? ফাঁসি হয়ে যাওয়া দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীর মা’ও তার সন্তানের জন্য চোখের জল ফেলেন। নাড়ীর সম্পর্ক যার সাথে সে নাড়ীতে টান পড়লে চোখে জল আসবে না তা কি হয় ?
বাসায় এত কিছু হচ্ছে তাও আমাকে হাসিমুখে মুনিমের সাথে কথা বলতে হচ্ছে। আমাকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে বিয়ের শপিং নিয়ে। আমি , বড় আপা, মুনিমের ছোট বোন মানে আমার ননদ অনি আর মুনিম এই চারজন মিলেই বিয়ের শপিং করতে যাব।বিয়ের শপিং নিয়ে সম্ভবত সব মেয়েদের মনেই একটা আলাদা প্ল্যান থাকে। আমারও কত রকম চিন্তা ছিল । এখন সেই চিন্তায় ভাটা পড়েছে।শফিক ভাইয়ের মতে বড় আপা হয়তো স্ত্রী হিসেবে ভয়ংকর বাজে হতে পারেন তবে বোন হিসেবে কিংবা মানুষ হিসেবে বড় আপার কোন তুলনা হয় না। স্থান-কাল-পাত্রভেদে এক এক জন মানুষ এক এক রকম হতে পারে? হয়তো পারে।
আম্মা বড় আপাকে আমার সাথে আসতে দিতে চান নি। কিন্তু মুনিমের পীড়াপিড়িতে আসতে হয়েছে। যদিও আম্মা বারবার বলে দিয়েছেন, বড় আপার ডিভোর্সের কথাবার্তা নিয়ে যাতে ভুলেও মুখ থেকে কিছু বের না করি।
‘ ইতির ব্যাপারে আবার কিছু বলিস না জামাইকে।তোর বিয়েটা হোক এরপর এই বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।’
কিন্তু চাইলেই তো অনেক কিছু গোপন করা যায় না। বড় আপার গোমড়া মুখ দেখে অনি বারবার এটা-সেটা জিজ্ঞেস করছিল।
‘ আপুর কি মন খারাপ? ‘
‘ দুলাভাইয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি, আপু ? ‘
আমি অনিকে বললাম, আসলে এতদিন তো আমি ওকে অনেক টেক-কেয়ার করতাম।এখন আমার বিয়ে হয়ে গেলে তো জামাইকে টেক-কেয়ার করব। এই ভয়েই তার মন খারাপ। হা হা হা।
বড় আপা এমনিতেই অনেক কথা বলেন , অথচ ইদানীং বেশ চুপ হয়ে গেছেন । নিজের আশু বিচ্ছেদ নিয়ে ভাবতে থাকলে কেউ ভালো থাকতে পারে না । এই কি আমার সেই বড় আপা যে আমার প্রতিবারের গোমড়া মুখকে এক তুড়ি মেরে উড়িতে দিত? আহারে আমার বড় আপা!
মুনিম ব্যাপারটা বেশ খেয়াল করেছিল। বড় আপা আর অনি যখন এক দোকানে হলুদের সাজ কিনতে গিয়েছিল তখন মুনিম এক ছুতোয় সিগারেট খাওয়ার জন্য শপিং মলের বাহিরে বের হতে চাইলো ।
আমাকে বলল, চলো, আমার এখানে দম বন্ধ লাগছে একটু বাইরে যাই।
অনিকে বলল, তুই আপুকে নিয়ে একটু হলুদের জিনিসগুলো দেখ। আমার দম বন্ধ লাগছে।
অনি বলল, তোর কেন দম বন্ধ লাগছে আমি জানিতো । এখানে তো বেশ অক্সিজেনের অভাব!
মুনিম ” বেশি বুঝিস ” বলে অনিকে চুপ থাকতে বলল।
আপুকে বলল, আপু আপনি আর অনি মিলে এটা দেখেন। আমি আর ও একটু বাহিরে যাই।আমার বেশ দম বন্ধ লাগছে এখানে।
আপু আর অনি চলে গেল। আমি আর মুনিম একটা টং দোকানের সামনে এলাম। মুনিম সিগারেট খায় এটা আমাকে আগেই বলেছে আস্তে আস্তে ছেড়ে দিবে। অনেকদিনের অভ্যাস তো ! একটু সময় চেয়েছে। আমি কিছু বলি নি।
মুনিম দুইটা চা আর একটা সিগারেট দিতে বলল টঙয়ের মামাকে।
‘ আচ্ছা , একটা প্রশ্ন করি?’
‘ কি প্রশ্ন? ‘
‘ বড় আপাকে এমন মন মরা লাগছে কেন ? ‘
‘ এমনিতেই । মন খারাপ হয়তো ।’
‘ আমাকে বলতে পারো। আমি কিন্তু তোমার বাইরের কেউ না। ‘
‘ তারপর ও কিছু কথা না জানা ভালো । ‘
‘ দুলাভাইয়ের সাথে কোন সমস্যা ? ‘
‘ হ্যাঁ , ওরা দুইজনই ডিভোর্স চাচ্ছে। ‘
‘মানে কি ! ‘
‘হ্যাঁ এটাই সত্য।’
‘ কিন্তু কেন? ‘
‘ উনাদের দুজনের নাকি একজনের সাথে আরেকজনের কোনভাবেই মিলছে না। ‘
‘ এটা কোন কথা হল! ‘
‘ হ্যাঁ । এটাই কথা । আর তুমি কিন্তু কোনভাবেই আপুর সামনে এসব নিয়ে কোন কথা বলবে না । ও আরেকটা কথা কালকে থেকে আপু আর আসবে না । তুমি আবার ওকে জোরাজুরি করবে না।
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। ‘
এরপর সেদিনের মত শপিং শেষ করে যে যার বাসায় চলে আসলাম। পরেরদিন শপিংয়ে বড় আপা আসেন নি। মুনিমও আর এবার জোরাজোরি করে নি। মোটামুটি বিয়ের সব কেনাকাটা শেষ করে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো। রাত ১১ টায় বরপক্ষের মেহমান আসলো আমাদের বাড়িতে। বরপক্ষের একজন মেহমানকে দেখে আমি বেশ শক খেলাম। আরে ইনি তো শফিক ভাই!
শফিক ভাই আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। হলুদ হাতে নিয়ে আমাকে আস্তে আস্তে বললেন, কি ছোটগিন্নী আমাকে ছাড়াই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে?
আমি কিছু বলতে যাব এমন সময় আমাকে থামিয়ে বললেন, আসল গিন্নী কই?
আমি বললাম, কই আর। সারাদিন রুমেই থাকে আর কান্নাকাটি করে।
শফিক ভাই আমাকে বলল, একা একা তোমাকে হলুদ দিতে ভাল্লাগছে না। দাঁড়াও ওইটারে নিয়ে আসি।
শফিক ভাই স্টেজ থেকে নেমে বড় আপার রুমের দিকে যাচ্ছেন। আমিও ওদের পিছু নিয়েছি। শফিক ভাই বড় আপার রুমে বারবার নক করছেন। বড় আপাও বারবার বলছেন, তোকে না বলেছি আমার শরীর খারাপ! তাও বারবার কেন নক দিচ্ছিস।
এক পর্যায়ে বড় আপা রুমের দরজা খুললেন। শফিক ভাইকে দেখে ওর অজ্ঞান হবার মত অবস্থা। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর শফিক ভাই কথা শুরু করলেন।
‘কাল রাতে মুনিম আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে কিছু ছবি পাঠিয়েছে।’
‘কিসের ছবি, কার ছবি?’
‘আপনার।’
‘ও’
‘মুনিম আমাকে ভিডিও কল করেছিল। আমি তো গত তিনমাস দাড়ি-চুল কিচ্ছু কাটি নি।’
‘কেন নাপিতের অভাব নাকি?’
‘নাহ।’
‘তাহলে কিসের অভাব?’
‘তোমার।’
‘কেন ডিভোর্স না চেয়েছিলে?’
‘আমরা তো অনেক কিছুই চাই। সব চাওয়া কি পূরণ হওয়া উচিত ?’
‘দাঁড়ি-চুল কাটলে কেন? কথাবার্তার সাথে মানাতো বেশ। একদম ফিলোসফার ফিলোসফার ভাব। ফিলোসফার শফিক সাহেব।’
‘একটা ব্যাপার খেয়াল করেছো?’
‘কি?’
‘ভালো থাকার জন্য আমরা আলাদা হতে চেয়েছি। অথচ সেই চাওয়ার জন্য আমরা কেউই ভালো নেই। না আমি, না তুমি, না আমাদের পরিবার।’
‘ আর চাইবে?’
‘না।’
মুনিম শফিক ভাইয়ের সাথে কথা বলেছে।ওইদিন শপিংয়ের সময় আমরা অনেক ছবিও তুলি। মুনিম সেই ছবিগুলোই শফিক ভাইকে পাঠিয়েছে। যেখানে বড় আপাকে বেশ মলিন আর বিষন্ন দেখাচ্ছিল। আর শফিক ভাইকে ভিডিও কল দেয়াতে দেখল উনিও আসলে ভালো নাই।মুনিম আমাকে এসবের কিছুই বলে নি। শফিক ভাইয়ের কথাবার্তায় বুঝতে পারছি এখন। যাক সেসব কথা।
এই মুহুর্তে বড় আপা হাসছেন।হেসে হেসে শফিক ভাইকে এটা সেটা বলছেন। কালো মেঘ দূরে সরে যাওয়াতে একটা অদ্ভুত সুন্দর নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে ।
শফিক ভাইও হাসছেন।
আমি কাঁদছি।
মুনিম কি করছে কে জানে।
…………………………………….
“নীল আকাশের ফিরে আসা”
-আলমগীর জনি।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?