বই: নন্দিত নরকে
লেখক: হুমায়ূন আহমেদ
ধরণ: সমকালীন উপন্যাস
প্রকাশনী: খান ব্রাদার্স, দিব্য প্রকাশ(২০০৫)
প্রথম প্রকাশ: ১৯৭২
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৭০
প্রচ্ছদ: মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কাইয়ুম চৌধুরী, ধ্রুব এষ (তিন বার প্রচ্ছদ করা হয়েছে বইটির)
মুদ্রিত মূল্য: ১২৫ টাকা (বর্তমান)
নন্দিত নরকে লেখার সময় আমার বয়স উনিশ-কুড়ির বেশি নয়। এই বয়সের একজন তরুণ কি এত ভেবেচিন্তে কিছু লেখে? আমার জানা নেই- আমি শুধু জানি ঐ রাতে একটি গল্প আমার মাথায় ভর করেছিল, গল্পের চরিত্রগুলি স্পষ্ট চোখের সামনে দেখছিলাম, ওদের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। ভেতরে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছিলাম- যেভাবে ওদের দেখছি হুবহু সেইভাবে ওদের কথা বলতে হবে।” -হুমায়ূন আহমেদ।
একটি ছোট উপন্যাস, গল্প বললেও ভুল হবে না- জীবনের গল্প। কত ব্যথা, কত আশা লুকিয়ে থাকে এক একটি প্রাণে! নিম্ন-মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের কিছু মানুষের সুখ-দুঃখ, স্বপ্ন আর দীর্ঘশ্বাসের আখ্যান “নন্দিত নরকে”। পাঠকপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস।
কাহিনী সংক্ষেপ:
উত্তমপুরুষে রচিত উপন্যাস “নন্দিত নরকে”। গল্পকথক খোকা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী রাবেয়া, জেদী ও সাহসী মন্টু, কিশোরী রুনু এই চার ভাইবোনকে নিয়ে দরিদ্র পিতামাতার সংসার। তাদের সাথে বাবার বন্ধু মাস্টার কাকাও থাকেন। খাবার, জামা কাপড়ের অভাব সব সময় লেগেই থাকে এই পরিবারে, উপরন্তু মানসিক গ্লানি,হতাশা তো আছেই। তবুও খোকা সব কষ্ট দূর করার স্বপ্ন দেখে, ভালো চাকরি, ভালো বাড়ির স্বপ্ন দেখে; স্বপ্ন দেখে পাশের বাড়ির শীলাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার। কিন্তু খোকার ভালো বেতনের চাকরি পাওয়ার খবর এই পরিবারকে বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাসে ভাসাতে পারে না। কেননা তখন এই পরিবারে নতুন সংশয়, ভয়ানক সংকট। এই আকাশ বিদীর্ণ করা নীরব হাহাকার থেকে মুক্তি নেই খোকার পরিবারের। কারণ অর্থের অভাব পূরণ হয়, মানুষের অভাব নয়।
কাহিনীর উত্থান ও ভালো লাগা:
হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন “নন্দিত নরকে” প্রকাশের পর তাঁর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পাঠকের কাছে সম্পূর্ণ নতুন একজন ঔপন্যাসিকের লেখা এত ভালো লেগেছিলো! এর বিস্তর কারণও আছে বৈকি! অতি সাধারণভাবে শুরু হওয়া উপন্যাসটি ধীরে ধীরে পাঠকমনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী রাবেয়াকে কাম-লালসা চরিতার্থে ব্যবহার করেন মাস্টার কাকা, পরিণামে তিনটি প্রাণ ও একটি ভ্রূণের করুণ মৃত্যু! মানুষের জৈবিক ক্ষুধার পরিণতি কত ভয়ানক হতে পারে, সল্পবয়সী লেখক মাত্র ৭০ পৃষ্ঠাতেই তা সুনিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। জেলগেটে লাশের প্রতীক্ষায় থাকা এক বাবার দীর্ঘশ্বাস কী করুণ, কী মর্মস্পর্শী! “নন্দিত নরকে” পাঠকের মনে চরিত্রগুলোর জন্য ব্যথার সৃষ্টি করবেই।
পাঠানুভূতি:
“নন্দিত নরকে” স্বল্প কলেবরের উপন্যাস, আমি একাধিকবার একটানে পড়ে শেষ করেছি। স্কুলে থাকতে প্রথম যখন পড়েছিলাম, তখন কেবলমাত্র দুঃখ-কষ্ট আর হাহাকারে পরিপূর্ণ একটি উপন্যাস বলে মনে হয়েছিলো। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবজীবন সম্পর্কে অনুধাবনের ক্ষমতা বেড়েছে। কদিন আগে পুনরায় পড়ে মনে হয়েছে, সাধারণ নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে এমন অভাব-অনটন আর মনোঃকষ্ট নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। গদবাধা উপন্যাসের মতো রোমান্টিসিজমে ভরপুর নায়ক-নায়িকা এখানে নেই।তবে কথকের মতো যারা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সংসারের অভাব দূর করার স্বপ্ন দেখে, তারাই বাস্তবে প্রকৃত নায়ক। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও যে তরুণ পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে আত্মসমর্থনের চেষ্টা করেনি, যার শেষ কথা ছিল “তোমাদের আমি বড়ো ভালোবাসি দাদা”, সেই মন্টু কি আমার মতো পাঠকের ভালোবাসা না পেয়ে পারে! চিরাচরিত মমতাময়ী মায়েরই প্রতীক খোকা-রাবেয়াদের মা, আর তাদের বাবাও যেনো সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে পর্যুদস্ত স্বল্প বেতনের চাকুরিজীবী বাবাদেরই প্রতিনিধি। সব মিলিয়ে সারাজীবন মনে রাখার মতো অপূর্ব একটি উপন্যাস “নন্দিত নরকে”।
সমালোচনা ও ব্যক্তিগত মতামত:
করুণরসে ভরা উপন্যাসটি আমাকে ভাবিয়েছে, আবেগাপ্লুত করেছে। তবে লেখক বয়সের হিসেবে কিছুটা বেখেয়ালি হয়েছিলেন। উপন্যাসে বলা আছে, রাবেয়ার বয়স বাইশ, যে কিনা কথকের চেয়ে এক বছরের বড়। সেই অনুযায়ী মাত্র একুশ বছর বয়সেই গল্পের কথক মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার্থী! আবার নিজের বারো পেরিয়ে তেরোতে পৌঁছানো কিশোরী ছোট বোনকে আদুরে, নিতান্ত ছেলেমানুষ হিসেবে উপস্থাপন করলেও বোনেরই সমবয়সী শীলার প্রেমে তিনি হাবুডুবু খাচ্ছেন! এই ছোটো খাটো দুই একটি ব্যাপার ছাড়া পুরো উপন্যাসে আর কোনো অসামঞ্জস্যতা নেই।
লেখককে নিয়ে কিছু কথা:
আজ হুমায়ূন আহমেদ বাঙালি পাঠকের কাছে জনপ্রিয় কথাশিল্পী। হিমু, মিসির আলি, বাকের ভাইয়ের মতো চরিত্রগুলো তাঁকে অমর করেছে। কিন্তু “নন্দিত নরকে” লেখার সময় জনপ্রিয়তা কিংবা স্বচ্ছলতা কিছুই ছিল না তাঁর। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস একজন লেখকের কাছে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ, আর স্বয়ং “নন্দিত নরকে”ই বলে দেয় হুমায়ূন আহমেদ কতটা সফল! অনেক মায়া নিয়ে দরিদ্র পরিবারটির প্রত্যেকের চিত্র এঁকেছেন তিনি, সর্বোপরি সকলের মন ছুঁয়ে যাওয়া একটি উপন্যাস।
প্রিয় কথামালা:
পুরো উপন্যাস জুড়ে ভালো লাগার লাইন সংখ্যা অনেক। সেখান থেকে কিছু উল্লেখ করি-
যে-সমস্ত মেয়ে হাসলে টোল পড়ে, তারা কারণে-অকারণে হাসে। তারা জানে হাসলে তাদের ভালো দেখায়।
কে যেন বলেছিল সিগারেটের আনন্দটা আসলে সাইকোলজিকেল। তুমি একটা কিছু পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছ, তার আনন্দ। অনেক আবার বলেন, নিঃসঙ্গের সঙ্গী। আমার মনে হয়, সিগারেটের নেশার মূল্যের চেয়ে বন্ধুত্বের মূল্য অনেক বেশি।
সব ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত। বৃত্ত দিয়ে ঘেরা। এর বাইরে কেউ যেতে পারবে না।
মেয়েদের মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয় ছেলেদেরও আগে। তারা তাদের কচি চোখেও পৃথিবীর নোংরামি দেখতে পায়। সে নোংরামির বড়ো শিকার তারাই। তাই প্রকৃতি তাদের কাছে অন্ধকারের খবর পাঠায় অনেক আগেই।
স্মৃতি– সে সুখেরই হোক, বেদনারই হোক– সব সময়ই করুণ।
নাট্যদল বহুবচন ১৯৭৫ সালে নন্দিত নরকের নাট্যরূপ দেয় এবং মঞ্চায়ন করে। কবি বেলাল আহমেদের এই উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র ২০০৬ সালে মুক্তি পায়।
রিভিউকারী:
রাশেদা সুলতানা নুছাইবা
শিক্ষার্থী (অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ), মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
ভালো লাগলে ১০ এর মধ্যে রেটিং দেয়ার অনুরোধ রইলো
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?