ছোটগল্পঃ দ্যাট ব্রাউন গার্ল হু স্টোল মাই হার্ট
ফোনের দিকে তাকিয়ে আমি যা দেখলাম তাতে মনে হল কেউ বুঝি সপাটে কষে থাপ্পড় লাগিয়েছে আমার মুখে। একটা নামি-দামি জাপানী ফটোগ্রাফার আমার সাথে সেরিনার একটা ছবি তার পেজে আপলোড দিয়েছে। তাতে দিয়েছে চমকপ্রদ ক্যাপশন- আই ওয়া উতসুকুশি। যার অর্থ দাঁড়ায় ‘ভালোবাসা সুন্দর’! ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে সেরিনা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর আমি চোখ বন্ধ করে হাসছি। সেদিন হাসপাতালে আমাদের সাধারণ একটা মুহুর্তকেই ফ্রেমবন্দী করেছেন এই ব্যক্তি!
ওরা অনেক হৈ হুল্লোড় করছে আর আমার পিঠে দুমদাম কিল চাপড় মারছে। কিন্তু আমার মাথায় কিছুই আসছে না সেরিনা ছাড়া!
সেরিনা একজন ঢাকাইয়া মেয়ে যে কিনা স্কলারশিপ পেয়ে জাপানে পড়াশোনা করতে এসেছে। ওর সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক বললেও ভুল হবে, কারণ খুব বেশিদিন হয়নি আমাদের দেখা হওয়ার। তাতেই এমন গুরুতর একটা ঘটনা রটে গেছে বলে ক্রোধ একইসাথে দুশ্চিন্তার স্রোত বয়ে গেল শরীর বেয়ে।
আমি ফোন খুলে ফেসবুকে ঢুকে হতবাক হয়ে গেলাম। বিখ্যাত বাঙালি পেজ গুলোও শেয়ার দিয়েছে ছবিটা। যেখানকার বেশিরভাগ কথাই- ভালোবাসায় গায়ের রঙ ম্যাটার করে না। যদিও জাপানি ফটোগ্রাফার এ ব্যাপারে কিছু বলেননি। তিনি তো আমাদের মতো গায়ের রঙ এর দিকে তাকিয়ে থাকেন না। জানি না, সেরিনা কি ভাবছে। ওর যদি বয়ফ্রেন্ড থাকে তাহলে আজই ব্রেকআপ হয়ে যাবে আর ও আমার উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে!
আমি গটগটিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। একা থাকতে চাই কিছুক্ষণ।
ফোনটা নিয়ে শুধু বিছানায় ঠেস দিয়েছি অমনি খুটখাট শব্দ করে ঘরের দরজার নবটা ঘুরিয়ে কে যেন দরজাটা খুলে ফেলল। লাফ দিয়ে উঠে বসলাম।
“আহ, তাহলে তুমি এখানে?” সেরিনা ঘরে উঁকি দিল। আজকে ওর পরনে কালো পাড় ও লাল আঁচলের শাড়ি। সম্ভবত এগুলোকে জরজেটের ইন্ডিয়ান শাড়ি বলে। সাথে কোমর পর্যন্ত কালো সতেজ চুল ও কালো ব্লাউজ সৌন্দর্যকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। গলায় একটা সুদৃশ নেকলেস ঝুলছে। পোশাক আশাক প্রমাণ করে বিরাট ধনকুবেরের মেয়ে।
দ্রুতপদে ঘরে ঢুকে দরজা ভিজিয়ে দিল (ভাগ্যিস লাগায়নি!)। চড়া হিল জুতায় আওয়াজ করে আমার দিকে এগিয়ে আসল।
“আমাদের নিয়ে এসব কী হচ্ছে?” কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ঘাড়টা কিছুটা বেঁকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল মায়াবতী সুকেশিনী। জানালা দিয়ে আসা বাতাসে তার মুখের উপর আঁছড়ে পড়া চুল গুলো দেখে আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করল। জানালা গলে বেরিয়ে আসা রোদের আলোয় ঠিকরে বেরুচ্ছে ওর বাদামী ত্বকের সৌন্দর্য। গায়ের রঙ যে সৌন্দর্যের মাপকাঠি না তা এই কাজল চোখের মেয়েকে দেখলেই যথেষ্ট।
আমি সোজা বসলাম। ও কোন ফাঁকে আমার বাড়িতে আসল?
“কি হচ্ছে মানে?” জেনেও জিজ্ঞেস করলাম।
“আমাদের দুজনকে নিয়ে রুমরস ছড়াচ্ছে কেন? আমরা কবে কাপল হলাম? জেনেও না জানার ভান করবে না” ছবি ভাইরাল হওয়ার ব্যাপারে যে সাংঘাতিক রকমের ক্ষুব্ধ হয়েছে ও সেটা চেহারা দেখে অনুমেয়। নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করে এসেছে। এখন আমার মতো নিরীহগোছের মানুষটার উপর ঝাল মেটাবে! এরকম সেল্ফ ডিপেন্ডেন্ট রাগী মেয়েরা নিরীহ গোছের ছেলেদের পছন্দ করে। দু একটা বন্ধুও রাখে এমন যাতে করে রাগের ঝাল মেটাতে পারে তাদের উপর। আর স্বামী এমন হলে তো দশে দশ!
“আমি আমি নিজেও জানি না” দায়সারাভাবে উত্তর দিলাম। আমি আসলেও তো জানি না ফটোগ্রাফার ব্যাটা কোন ফাঁকে এমন ছবি তুলল।
“তুমি নাহয় নন ফেমাস মানুষ বাট আমি একজন ইনফ্লুয়েন্সার! আমার কত ফ্যান ফলোয়ার! তারা আমাকে নিয়ে এখন কত আকাশ পাতাল ভাবছে ভাবা যায়?” ধপ করে খাটে বসে পড়ল ও। নরম বিছানা দুলে উঠল। আমি একটু পিছনে সরে বসলাম। মেয়েলি পারফিউমের গন্ধে ঘর ভরে গেছে। জেসমিন সুগন্ধি। কেন যেন মনে হচ্ছে এমন পারফিউম খুব চেনা। হয়ত আসুকা ব্যবহার করে। তবে সেরিনার শরীরের সাথে মিশে সেটা হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য।
“তুমি কি ঐ ফটোগ্রাফারকে ছবি ডিলেট করে দিতে বলো নি?”
“বলে কি হবে? যা হওয়ার তা হয়েই গেছে। আমার বয়ফ্রেন্ডরা কি ভাববে!” ‘রা’ কথাটা মাথার মধ্যে দুবার ঘুরপাক খেল। বহুবচন শব্দ দিয়ে ও কী বোঝাতে চাচ্ছে! আস্ত প্লেগার্ল মনে হচ্ছে।
“না মানে, আমার লাভার রা আরকি” কাঁচুমাঁচু হয়ে বলল ও।
“বাংলা পেজ গুলো আরও বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। ভালোবাসায় গায়ের রঙ ম্যাটার করে না ব্লা ব্লা। ভালোবাসা আসলো কোথা থেকে!” ঠোঁট পাউট করে বসে রইল। তাতে ও কে যে কি মিষ্টি দেখাচ্ছে বলে বোঝাতে পারব না।
“এই যে দেখো” প্রায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার মতো করে ওর ফোনটা দেখাল। ফোনের স্ক্রিনে আমাদের সেই ছবিটা দেখা যাচ্ছে। কয়েক হাজার লাইকের ফেসবুক পেজ। ক্যাপশন দিয়েছে, ‘কালো মেয়েরাও ভালোবাসা পায়’
তার নিচে আরেকটা পোস্ট, যেখানে ফর্সা মেয়েমানুষের পায়ের ছবি দেয়া। যাকে সোজা বাংলায় ‘ধলা’ বলে। তাতে ক্যাপশন লেখা ‘তোমার পা এমন সুন্দর মানে তুমি সুন্দরী’
আমি কিছুটা ইতস্তত করে একবার ওকে দেখলাম একবার ছবিটা। ওর চোখের ঈষাণ কোণে জমে থাকা পানি আমার নজর এড়ালো না। ক্ষোভ ও বেদনা উভয়ের বহিঃপ্রকাশ এই অশ্রুকণা তা আর বলে দিতে হবে না।
“বাংলা পেজগুলাকে দেখতে ইচ্ছা করে না। মাঝে মাঝে এমনসব পোস্ট দেয়। রিপোর্ট দিয়ে উড়িয়ে দিব শয়তান পেজ গুলাকে। অ্যাডমিন জানোয়ারগুলাকে খেয়ে ফেলতে মন চায়” দাঁতে দাঁত পিষে বলল। যেন সত্যিই সামনে পেলে জ্যান্ত খেয়ে ফেলবে তাদের!
আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নানান কথা। বডি শেমিং মারাত্মক ব্যাধি। ‘মেয়েটা সুন্দর কিন্তু গায়ের রঙ আরেকটু সুন্দর হলে ভালো হত’ এ কথাগুলো কেউ নিজের অজান্তেই বলে, কিছু অবুঝরা চিন্তাভাবনা না করেই বলে। আবার কিছু মানুষ হিংসার বশবর্তী হয়েও বলে। যাকে নিয়ে মন্তব্য করা হয়েছে তার অনুভূতি তারা বোঝার চেষ্টাও করে না। আমি নিজের চোখেই দেখেছি, আমার বোনের গায়ের রঙ আমার থেকে কিছুটা চাপা ছিল বলে মুখের উপর বলে দিত, ‘ভাইয়ের মতো ফরসা হয়নাই। পোলা মানুষ একরকম হইলেই হইল। কিন্তু মাইয়া মানুষ’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
“তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করে এসেছ?” প্রশ্নটা করে হয়ত আগুনে ঘি ঢাললাম।
“অ্যাই আমার বয়ফ্রেন্ড আছে কে বললো তোমাকে?”
“না মানে তোমার মতো সুন্দরীর বয়ফ্রেন্ড থাকতেই পারে” ইতস্তত করে বলেই ফেললাম। কতক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল আমার দিকে।
“তুমিও তো হ্যান্ডসাম তোমার যে গার্লফ্রেন্ড নেই”
“আমি তো আমিই”
“কে বলল আমি সুন্দরী? আমি ফর্সা নাকি? আমার গায়ের রঙ তো ময়লা” গলার স্বরে বোঝা গেল জেদ করে কথাগুলো বলল। যার সাথে কাজ করছে অসীম ক্রোধ।
“আমার জাপানিজ ফ্রেন্ডরা বলেছে। তোমার ফ্যান ফলোয়াররা বলে। ব্রাউন সুন্দরী”
“জানি তাও-”
“শোন,” ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম। ওর কালচে খয়েরি মণি দুটো কাঁপছে আবেগে,
“আমাদের সমাজের সবচেয়ে বাজে দিক হচ্ছে গায়ের রঙটাকে একটু বেশিই দেখা হয়। জাপানের যে ব্যক্তি ছবিটা পোস্ট করেছে সে এই বিষয়টাকে মোটেও মিন করে নাই। ইভেন কমেন্টেও কেউ এমন কিছু বলেনি। অথচ বাংলা পেজগুলোই ব্যাপারটাকে ক্রিঞ্জ করে ফেলেছে। তুমি মোটেও কালো মেয়ে না। গায়ের রঙ বাদামী। আর নিজেকে আয়না দেখেছ? আল্লাহ তোমাকে কি দিয়েছে?” ওর চেহারার অভিব্যক্তির খুব একটা পরিবর্তন দেখলাম না। যেন আরও বেশি আবেগ উথলে পড়ছে। কে জানে কখন কেঁদেই ফেলে! আর যদি আমার কোলে ঢলে পড়ে তাহলে তো নিশ্চিত হার্ট অ্যাটাকে আজকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে আমার। অবশ্য মেয়েমানুষের কান্না দেখে হাসপাতালের ভর্তি হয়েছে এমন ঘটনা কখনো দেখিনি।
একটু কেশে বিজ্ঞদের মতো বললাম,
“আর হ্যাঁ ফর্সা পা নিয়ে কথা বলেছে তো? গুগলে সার্চ দিয়ে দেখ, পৃথিবীর কুৎসিততম মানুষটাকে। একজন মেয়ে আসবে যে কিনা ফর্সা। আমি তাকে অপমান করছি না, শুধু বলতে চাচ্ছি যে সে তো ফর্সা, তাহলে সে কেন আগ্লিয়েস্ট পার্সন হল? তার হাত পা কি সাদা না?”
ওর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। মেয়েরা অবিশ্বাসের ক্ষেত্রে এমনভাবে হাসে। কিন্তু আমি অবিশ্বাস্য কোন কথা বলিনি। একদম খাঁটি কথা এগুলো। এমনটাই ভাবা উচির সবার। কিন্তু বাঙালিরা হুজুগে জাতি। এক জিনিসকে নিয়েই থাকে। সৌন্দর্য বোঝার জন্য যে সৃজনশীল মানসিকতা থাকা লাগে তা বেশিরভাগের মুণ্ডুতে নেই।
“তুমি অনেক মেধাবী আর পজিটিভ মানুষ, কারিম” বলে ও আমার হাতে হাত রাখল। উষ্ণ কোমল স্পর্শ। আমি কিছু বলতে চাইলাম। ঠোঁট নাড়লাম, কিন্তু কিছু বের হল না। তাহলে কি সত্যিই আমি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে রেকর্ড গড়তে যাচ্ছি?
“তোমার মতো মানুষের খুব দরকার আমাদের সমাজে। সুন্দর চিন্তাভাবনা গুলোকে প্রচার করবে বুঝেছ?”
আমি শত চেষ্টায় মুখ খুলতে পারলাম, “জানো, তুমিও একদিন প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মতো দেখিয়ে দিতে পারবা ব্রাউন হয়েও মিস ওয়ার্ল্ড হওয়া যায়, ক্যামিলা ক্যাবেলোর মতো নিজের স্কিন নিয়ে সন্তুষ্টি। আর যোগ্যতার কথা তো বাদই দিলাম।” আমার কথা শুনে মুক্তার মতো দাঁতগুলো বের করে একখানা হাসি উপহার দিল, যা দেখে হৃদয় সমুদ্রের জলে ঢেউ বয়ে গেল। ওর চোখের মায়ায় ডুবে গিয়ে ভালোবাসি বলতে গিয়েও মাঝপথে থেমে গেলাম। সেটা বলার সময় ও যোগ্যতা এখনো হয়নি আমার।
লেখকঃ আয়শা সিনীন খান
[<বিঃদ্রঃ লেখাটি প্রকাশিতব্য উপন্যাস রক্তাক্ত লকেট এর কিছু অংশ থেকে নেয়া>]
Leave a comment