আপনি কি হুমায়ুন আহমেদের ‘প্রেমের গল্প’ পড়েছেন অথবা ইমদাদুল হক মিলনের ‘তোমাকে ভালোবাসি’? অথবা বাংলা সাহিত্যের শত অযুত সহস্র পাতার রচিত কোন প্রেম কাহিনী? (যার প্রায় পুরোটা জুড়ে বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের উপাখ্যান)। হয়তো পড়েছেন হয়তোবা পড়েননি। তবে এই দুষ্ট মিষ্টি প্রেমের গল্পের উপাখ্যানে বিভোর হয়েছে বহু তরুণ তরুণী। সপ্নের ডালপালা মিলিয়ে আকাশছোঁয়া কল্পনার ভেলায় কত যুবক যুবতী যে পাড়ি দিয়েছে….
কিন্ত…?
এ যে বন্ধুর পথ, পথের ভাজে ভাজে বিপদের হাতছানি, দুর্গম গিরি কান্তার মরু জয় করে রোমান্সে ভরা প্রেমের শুরুর শেষটা হয় অশ্রুজলে প্লাবিত। কারো জীবনের ইতি ঘটে আত্নঘাতে, কারো বা লজ্জার জীবন উপহার। কারণ এ যে ‘হারাম প্রেম’। আর হারামে কখনোই প্রকৃত সুখ নেই। অথচ একটু শরীয়াহ’র গন্ডিতে আশ্রয় নিলেই গল্পগুলো অন্যরকম হতে পারতো। হারাম সম্পর্ক বদলে হতে পারতো হালাল ফ্লেভারের প্রেম। পারিবারিক বন্ধন গুলো থাকতো অটুট। পথহারা সমাজটা পেতো পথের দিশা। সেই অন্যরকম কিছু জীবন জাগার গল্প নিয়ে শাইখ আতীক উল্লাহ’র গল্পের সমাহার ‘ওগো শুনছো’ বইখানি। বাংলা সাহিত্যে বিবাহ বহির্ভূত হারাম রিলেশন নিয়ে যত দিস্তা দিস্তা লেখা হয়েছে, সে তুলনায় বিয়ের পরে স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র প্রেম-ভালোবাসা বা পারিবারিক জীবনের গল্পগুলো নিয়ে রচনা খড়ের গাদায় সুচ খোজার মতই অবস্থা। পশ্চাত্যের নির্লজ্জ দাসত্বে বন্দি সাহিত্যিকদের কাছে অবশ্য এর থেকে বেশি আশা করা যায়না। অথচ ঐশী বাণীর আলোকে কত মধুময় জীবন যে আমরা পেতে পারি, তার মোহনীয় লেখনিতে ভরপুর ‘ওগো শুনছো’ বইখানি। যেখানে একটু নাইতে নামলে মনে হবে আরেকটু সাতরে নেই, কিছুক্ষণ পর মনে হবে একটু ডুবজল খেলি, তারপর মনে হবে অতল গহীনে ডুব দেই, গভীর তলদেশ থেকে সেচে আনি মুক্তোমালা, যে মালায় জীবন হবে পূতিময় সৌন্দর্যে রাঙানো….

‘ওগো শুনছো’ বইটির পুরোটা জুড়ে আছে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, দুষ্টুমি-খুনসুটি, এর ফাকে ফাকে কিছু আন্তরিক উপদেশবাণী, কিছু সাংসারিক জীবনের চুটকি টিপস আর মুমিনদের পৃথিবী নিয়ে লেখকের গহীন হৃদয়ের সপ্নগাথার কথামালা। সর্বমোট ১৭ টি জীবনঘনিষ্ঠ গল্পে মোড়ানো। না, গল্প শুধু গল্প নয়, কিছু দামী কথাও আছে অল্প। যার মাধ্যমে লেখক আমাদের দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন গঠনের কিছু সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রত্যেকটি গল্পই আমাদের কিছু জানাতে চাইবে, কিছু শেখাতে চাইবে।
পুরো বইয়ে একটি বিষয় লক্ষণীয়, লেখক বইয়ে মাদ্রাসার হুজুর-হুজরানি ও তালিবে ইলমদের জীবনচিত্র দক্ষ হাতে তুলে ধরেছেন। তাদের সহজ-সরল, বাহুল্যবর্জিত ,তাকওয়া ও পরহেজগারীর জীবন আমাদের এক অন্য ভুবনে নিয়ে যাবে। আসলে যান্ত্রিক এ সভ্যতার সাথে তাল মিলাতে গিয়ে আমরা জীবন থেকে অনেক কিছু হারিয়েছি। আমরা আধুনিক হয়েছি, কিন্ত অন্তঃসার শুন্য হয়ে পড়েছি। অথচ এখনো গ্রামীণ জীবনে আধুনিক অনেক উপকরণ না থাকলেও তাদের মাঝে আন্তরিকতা আছে, আত্নিক হৃদ্যতা আছে, পরস্পরকে সাহায্য করার মানসিকতা আছে। তারা অল্পে তুষ্ট থাকে, চাহিদা কম থাকায় স্বল্প আয়েও অনেক সুন্দর জীবন যাপন করতে পারে। ‘ওগো শুনছো’ বইয়ের গল্পগুলো আমাদের এমনই এক জীবনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে যা এখনকার প্রজন্ম কল্পনাতেও আনতে পারবে না।

পুরো বইটা জুড়ে রয়েছে পারিবারিক সমস্যাবলীর কিছু মোক্ষম দাওয়া। প্ৰত্যেকটি গল্প আপনাকে জীবনের সমস্যা গুলোর সমাধানে কিছু না কিছু সাহায্য করবেই।










পরিবার হলো সমাজের ক্ষুদ্রতম ও শক্তিশালী একক। পশ্চ্যাত্যের সমাজে পরিবার কাঠামো অত্যন্ত ভঙ্গুর, সেই ভাঙ্গনের ঢেউ মুসলিম পরিবার গুলোতেও আছড়ে পড়ছে। নৈতিকতার চরম অবক্ষয়ে আমাদের মুসলিম পরিবারগুলোও ধীরে ধীরে আক্রান্ত হচ্ছে। হারাম প্রেমের ফাঁদে কেন মুসলিম পা দেবে? তার জন্য হালাল সকীনাহ’র ব্যবস্থা আল্লাহ সুবহানু ওয়াতায়ালা তো করেই রেখেছেন। কিন্ত পরিতাপের বিষয় পশ্চ্যাত্যের অশ্লীল, বেহায়াপনার সংস্কৃতিতে মোহাচ্ছন্ন হয়ে আমাদের মুসলিম তরুণ-তরুণীরা তা আজ ভুলতে বসেছে। বিবাহ বহির্ভূত প্রেমে তারা অলীক সুখ খুজছে। আবার বিবাহ পরবর্তী দাম্পত্য জীবনেও অনেকে সুখ খুঁজে পাচ্ছেন না, অথচ স্ত্রীর মাঝেই আল্লাহ তায়ালা প্রশান্তি রেখেছেন। আসলে আমাদের অন্তরে কালিমা লেগে আছে, বিবেক ঘুমিয়ে আছে। তাকে জাগাতে হবে, তাকে জানাতে হবে। আমাদের সন্তানগুলিকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আদর্শ করে গড়ে তুলতে হবে, তাকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন তারা আমাদের চোখের শীতলতার কারণ হয়। পরিবার থেকেই এর ভীত গড়ে তুলতে হবে। একটি আদর্শ, সুখী, তাকওয়া ও পরহেজগারে সুরভিত পরিবার গঠনে এই বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বিবাহিতদের জন্য সুন্দর একটি পরিবার গঠনে বইটি অত্যন্ত সহায়ক হবে। আর অবিবাহিত মিসকিনদের জন্যও কম কিছু নয়। বইটি পড়লে ‘চিরকুমার’ থাকার প্রতিজ্ঞা করা ছেলেটিরও সংকল্পে চিড় ধরবে নির্ঘাত। এক অব্যক্ত ভালোবাসার তৃষ্ণায় প্রাণটা আকুপাকু করবে। মনে হবে অনেক তো হলো, এবার গাঁটছড়া টা বেঁধেই ফেলি…..।

শাইখ আতীক উল্লাহ। একজন সৃজনশীল লেখক, লেখাই যার ধ্যান জ্ঞান, লেখাই যার নেশা। একজন সফল গল্পকার। তবে শুধু গল্পতেই সীমাবদ্ধ নয় তার লেখনী। তিনি লিখছেন; গল্প, অনুগল্প, উপন্যাস, উপন্যাসিকা। ঈমানী চেতনা জাগ্রত করতে তার লেখার জুড়ি মেলা ভার। তার প্রতিটি বই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। শাইখ আতীক উল্লাহর বিশাল এক পরিচয়, তিনি ‘কুরআনের পাখি’। কুরআনের ভালোবাসায় টইটম্বুর তার শ্রেষ্ঠ রচনা ‘আই লাভ কুরআন’ ও ‘সুইটহার্ট কুরআন’।
এছাড়া তার ‘জীবন জাগার গল্প’ ও ‘ইতিহাসের শিক্ষা সিরিজ’ পাঠকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। তার রচনা অত্যন্ত সাবলীল, প্রাণবন্ত এবং জীবনঘনিষ্ঠ হওয়ায় সহজেই পাঠকের মনযোগ কেড়ে নেয়। পেশাগত জীবনে তিনি একজন মাদ্রাসা শিক্ষক। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২৪ টির উপরে।





রিভিউ লিখেছেনঃ Abrar Faisal