মাহমুদুল হকের লেখার সাথে এই প্রথম আমার পরিচয়, এবং অন্যান্য পাঠকদের মতই খুবই আশ্চর্যজনকভাবে আমিও আবিষ্কার করলাম তার শিল্পসমৃদ্ধ লেখনশৈলীর বুননে আবৃত জীবনঘনিষ্ঠতা এবং মনস্তাত্ত্বিক রূপরেখাকে।
উপন্যাসের প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ-পূর্ববর্তী সেই সংঘাতময় সময়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত, যে সময় অনেককেই বাধ্য করেছিলো অস্তিত্ব সংকটে ভুগতে; যে সময়ে মানুষ তার অসহায়ত্বের বহিঃপ্রকাশ করতেও দ্বিধা করেনি একবারও; যে সময় পারিবারিক মায়া মমতার ছায়ায় বেষ্টিত পরিমন্ডল থেকে বেরিয়ে বাধ্য করেছিলো রাজনৈতিক ডামাডোলে পিষ্ট হতে। ব্যক্তিত্বে-মননে-চেতনায়-আচরণে শুধুই দেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদ, যা অগ্নি-স্ফুলিঙ্গের মতো ঝরে পড়তো খোকা-মুরাদ-রহমান-ইয়াসিনের কথোপকথনে। তবে এই দলের মাঝে খোকার ব্যক্তিত্বের একাংশই ছিলো উদাসীনতার ঘেরাটোপে আবৃত; সে যেন সেই সময়ের মানুষ হয়েও সবার থেকে কোন কিছুতে আলাদা, নির্লিপ্ত কেউ। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের আবহ যেন খোকাকে স্পর্শ করেও করত না, যতটা প্রভাবিত হয়েছিলো মুরাদ, ইয়াসিনেরা। খোকার সেই নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা কি আটকে রাখতে পেরেছিলো যুদ্ধকে? সময় তো মানুষের অবাক মনস্তত্ত্বের ধার ধারেনা কখনই।
পুরো উপন্যাস জুড়ে আমি যেমন মোহাবিষ্ট হয়েছি লেখকের শক্তিশালী লেখনীর জোরে, তেমনি মুগ্ধ হয়েছি রঞ্জুর চরিত্র চিত্রায়ণেও। নীলাভাবী, বেলী, এমনকি লুলু চৌধুরী্কে জৈবিক আকর্ষণের প্রতীক বলা গেলেও রঞ্জু তাদের সকলের ঊর্ধ্বে থাকা কেউ একজন, যাকে কল্পনা করে মন অপরিসীম স্নিগ্ধতায় ভরে যায়, যার সরলতা, নিষ্পাপত্ব যেন শিশিরস্নাত ভোরের মত, নিঝুম, নিরিবিলি। সত্যি বলতে, ৭০-৭১ এর মাঝামাঝি সেই রাজনৈতিক সংকটাপন্ন সময়টিতে খোকা আর রঞ্জুর মায়ায় ঘেরা কথোপকথনই আমার কাজে রিলিফ জোন হিসেবে কাজ করেছে। কিছু কিছু সময়ে তাদের আপন ভাইবোন কম, বরং দুই সুহৃদ মনে হয়েছে বেশি।
উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রকেই মনস্তাত্ত্বিক ক্যানভাসে ধরে রেখে আপন রঙ তুলির মিশেলে এঁকেছেন মাহমুদুল হক। তাদের প্রতিটা ডায়ালগ, শব্দ যেন এক একটি শক্তিশালী বোমা।
“খোকা শিউরে উঠলো, এতদিন তার কাছে যা ছিল দয়িতা, যামিনী, মদিরার মতো তিন অক্ষরের হালকা পালকে মোড়া পাখির মতো নিছক একটি রোগা শব্দ, এখন তা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ছড়িয়ে পড়েছে শহরময়, জনতা!”
তার সার্থক, সাবলীল শব্দচয়ন, উপমার ব্যবহার পুরো উপন্যাসকে এক অজানা অনুভূতি ও আবহ প্রদান করেছে। এই অজানা অনুভূতি ও আবহের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়েই আমি গোটা উপন্যাসটিকে দেখেছি একটি পূর্ণাঙ্গ দেশকে ধারণ করে উঠতে, দেখেছি ইতিহাসকে জীবনঘনিষ্ঠ মনস্তত্ত্বের আবরণে মুড়ে দিতে।
সবশেষে উপন্যাস থেকে পছন্দের দুটো উক্তি তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না–
“আসলে জীবন মানেই শৈশব; জীবনভর মানুষ এই একটা ঐশ্বর্যই ভাঙ্গিয়ে খায়, আর কোনো পুঁজিপাট্টা নেই তার।”
“কারো জন্য মন খারাপ করার বিশ্রী ব্যাপারটা না থাকলে দুনিয়াটা সত্যিই একেবারে ফিকে পানসে হয়ে যেত।”
পাঠ প্রতিক্রিয়া
জীবন আমার বোন
লেখকঃ মাহমুদুল হক
ধরনঃ সামাজিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক উপন্যাস
প্রথম প্রকাশঃ মে, ১৯৭৬
প্রকাশনীঃ সাহিত্য প্রকাশ
মোট পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১৫৮
Leave a comment