কয়েক মাস আগে পড়েছিলাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জননী’। আর সম্প্রতি শেষ করলাম শওকত ওসমানের ‘জননী’। দুই জননীর মধ্যে স্পষ্ট ফারাক আছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জননী মফস্বল ও শহরের, আর এই জননী পুরোপুরি গ্রামের। গ্রামের কঠিন জীবন-সংগ্রামই তাকে মাহাত্ম্য দান করেছে।
বই: জননী
রচয়িতা: শওকত ওসমান যত
প্রকাশক: সময় প্রকাশন
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ২০৮
মুদ্রিত মূল্য: ১৫০ টাকা
শওকত ওসমানের ‘জননী’র নাম দরিয়াবিবি। মহেশডাঙার দরিদ্র কৃষক আজহার খাঁর স্ত্রী সে। অন্তঃপুরের আর সাধারণ মুসলিম নারীর মতোই তার জীবন। তবে দরিদ্র আজহার খাঁ যখন জীবন সংগ্রামে পর্যুদস্ত, তার কিছুটা আঁচ দরিয়াবিবিকে সইতে হয় বৈকি। এছাড়া আজহার খাঁর খামখেয়ালি আচরণও দরিয়াবিবির কঠোর পর্দার নিয়মকানুনকে কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্থ করে।
দরিয়াবিবি তার সন্তানদের শিক্ষিত করতে চায়, মানুষ করতে চায়। তবে দারিদ্র্যের কষাঘাতে তার এই স্বপ্ন পদ্মপাতার জলের মতো মনে হয়। এজন্য তাকে সাহায্য নিতে হয় পরিপার্শ্বের বিভিন্ন ব্যক্তি। কিন্তু তার বিনিময়ে যে তাকে মূল্য দিতে হবে তা কি বুঝতে পেরেছিল অবলা গ্রাম্য জননী?
শওকত ওসমান এই উপন্যাসে দুটি বিশেষ বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন।
এক. হিন্দু-মুসলিম সমস্যা। মহেশডাঙার হিন্দু মুসলিমরা পরস্পরের বন্ধু হিসেবে জীবনযাপন করতো। কিন্তু দুই জমিদারের রেষারেষি তাদের প্রাত্যহিক সহজ-সরল জীবনেও প্রভাব ফেলে। তবে গ্রামের লোকেরাও পরে বুঝতে পারে যে তাদের মতো উলুখাগড়ার কথা আদতে জমিদাররা কখনও ভাবে না। পারস্পরিক কোন্দলের ইতি ঘটেও সেখানে।
এক জায়গায় চন্দ্র কোটালের স্ত্রী এলোকেশী তাকে বলছে, ‘জমিদার জমিদারে ঝগড়া। বড়লোক বড়লোকে দলাদলি। তোদের কী? গাঁয়ে হিন্দু মুসলমানে ঝগড়া তো ভাইয়ের সঙ্গে কী!’
দুই. পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। দরিয়াবিবির প্রথম স্বামী মারা যাওয়ার পরে তাকে তার দেবরদের কাছে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এমনকি ফেলে আসতে হয় তার সন্তান মোনাদিরকে। আর আজহার খাঁর মৃত্যুর পর দরিয়াবিবির উপর ইয়াকুবের কর্তৃত্ব পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিষ্ঠুর আধিপত্যকেই নির্দেশ করে।
প্রকৃতপক্ষে, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গ্রামের চিত্র দেখানোর মাধ্যমে ঔপন্যাসিক এক নারীর মাতৃমূর্তি অঙ্কন করেছেন। উপন্যাসের শেষাংশ পড়তে পড়তে যেকোনো সংবেদনশীল পাঠকের মন আর্দ্র হয়ে উঠবে।
Leave a comment