বইয়ের নামঃ চাঁদের পাহাড়
লেখকঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রচ্ছদঃ ধ্রুব এষ
প্রকাশনীঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৫০ টাকা
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার প্রিয় লেখক। পথের পাঁচালীর মাধ্যমে লেখকের সাথে পরিচিত হই এবং একে একে প্রায় সব লেখাই পড়া হয়েছে। ‘চাঁদের পাহাড়’ আমার অন্যতম প্রিয় একটি লেখা। গ্রাম-বাংলার এক যুবকের আফ্রিকায় এডভেঞ্চারের গল্প।
১৯০৯ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে তখনো ৫ বছর বাকি। অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে শঙ্কর সবেমাত্র এফ. এ. (বর্তমান সময়ের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সমতুল্য) পাস করে গ্রামে এসেছে। হাতে কোনো কাজ নেই। সারাদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা, মাছ ধরা, দুপুরে ভাতঘুম দিয়ে সময় কেটে যাচ্ছিল। শঙ্কর পড়ালেখায় খুব ভালো না হলেও বিভিন্ন খেলাধুলায় খুব নাম করেছিল। তবে তার সবচেয়ে আগ্রহের বিষয় ছিল নতুন কিছু জানা। পৃথিবীর কোথায় কী আছে, মহাকাশের কোন নক্ষত্র কখন কোথায় অবস্থান করে এসব শঙ্করের নখদর্পনে। এডভেঞ্চারের বই পড়ে নিজেকে মার্কো পোলো কিংবা রবিনসন ক্রুশো মনে হয় শঙ্করের।
শঙ্করের বাবা অসুস্থ তাই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে চলে আসে। কিন্তু চাকরি পাওয়া ত সহজ নয়। আর শঙ্কর ছোটখাটো চাকরি করতে ইচ্ছুক নয়। শঙ্করের মা গ্রামের এক আত্মীয়কে বলে পাটের কলে শঙ্করের কাজের কথা বলেছিলেন। সে শেষমেশ কিনা পাটের কলের বাবু হয়ে সকাল বিকাল দৌড়াদৌড়ি করবে! তবে শঙ্করের জীবনে অপ্রত্যাশিতভাবে একটি ঘটনা ঘটে যায়। গ্রাম সম্পর্কের দিদি ননীবালার স্বামী দুইবছর যাবত নিখোঁজ ছিল। এতদিন পর তিনি পূর্ব আফ্রিকার মোম্বাসা শহর থেকে চিঠি পাঠান। সেই ঠিকানাতেই শঙ্কর চিঠি দিয়ে বসে। যদি সে কোনোভাবে ওখানে যেতে পারে! চিঠির উত্তর নিয়ে শঙ্কর যখন হতাশ হয়ে পড়ে তখনই উত্তর আসে এবং শঙ্করের চাকরি জুটিয়ে দেওয়ার ভার নেন তিনি।
শঙ্করের চাকরি হয় উগান্ডা রেলওয়ে কন্সট্রাকশন ক্যাম্পের কেরানী ও সরকারি স্টোরকিপার হিসেবে। বাড়িঘর তখনো তৈরি না হওয়াতে সকলকেই তাঁবুতে থাকতে হয়। দিনের বেলা ঠিকঠাক কাজ চললেও, সিংহের উপদ্রবে রাতে ঘুমানো খুব অসুবিধা। কয়েকজন কুলিকে সিংহ ধরে নিয়ে গেলে বাকি কুলিরা কাজে যোগদানে অস্বীকৃতি জানায়। তবুও তাদের বুঝিয়ে এবং অস্ত্র হাতে পাহারা দিয়ে তাদের কাজ চলমান রাখতে হয়। কিছুদিন পর শঙ্করকে কিসমু থেকে ত্রিশ মাইল দূরের এক রেলস্টেশনে স্টেশন মাস্টার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নতুন পদ পেয়ে খুশি শঙ্কর। দিনে মাত্র দুইটি ট্রেন এই লাইনে চলে, তাই শঙ্করের অখণ্ড অবসর। রেলস্টেশনে দ্বিতীয় কোনো কর্মচারী নেই বিধায় সবসময় নিজের মনেই বিভিন্ন কাজ করে সময় কাটায় শঙ্কর।
সত্যিকার এডভেঞ্চার বলতে যা হয়, সেটা শঙ্করের জীবনে আসে ডিয়াগো আলভারেজের সাথে পরিচয় হওয়ার পর। একদিন সকালে শঙ্কর মাছ ধরার সময় দূরে মৃদু আর্তচিৎকার শুনতে পায় এবং কাছে গিয়ে মরণাপন্ন এক ব্যক্তিকে আবিষ্কার করে। ইউরোপিয়ান লোকটির পরনে তালি দেওয়া ছিন্ন জামাকাপড়। শঙ্কর দেখেই বুঝতে পারে লোকটি দীর্ঘদিন আফ্রিকার মনুষ্যবিহীন অঞ্চলে পথ হারিয়ে ঘুরেছে। শঙ্কর সেবা করে আলভারেজকে সুস্থ করে তোলে। অসুস্থ থাকার সময় আলভারেজ শঙ্করকে এক অদ্ভুত গল্প বলে। সেই গল্পের টানেই শঙ্কর আলভারেজের সাথে বেরিয়ে পড়ে এডভেঞ্চারের নেশায়। শঙ্কর ও আলভারেজ কি পারবে তাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তুর সন্ধান পেতে?
আদর্শ এডভেঞ্চার গল্প বলতে যা বুঝি, ‘চাঁদের পাহাড়’ তেমন একটি বই। একজন লেখকের সবচেয়ে বড় গুণ হলো সৃজনশীল চিন্তাশক্তি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কখনো আফ্রিকায় যান নি, অথচ বইটি পড়লে মনে হবে লেখক যেন নিজ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শঙ্করকে চালিত করেছেন আফ্রিকার প্রান্তরে। বইটি পড়তে পড়তে পাঠক নিজেকে কখন যেন শঙ্করের জায়গায় আবিষ্কার করবেন টেরও পাবেন না। অদম্য সাহসী চরিত্র শঙ্কর যেন অনুপ্রেরণার প্রতীক। অধিকাংশ পাঠকই বইটি পড়েছেন; তবে যারা এখনো পড়েন নি, অসাধারণ এক এডভেঞ্চারের সহযাত্রী হতে বইটি পড়ুন। হ্যাপি রিডিং।
Leave a comment