ঘুম থেকে উঠে দেখি বউয়ের ঠোঁট মুখ শুকিয়ে কাঠ কয়ে আছে। বুঝতে পারলাম নাস্তা করে নি। ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আজো নাস্তা করো নি? বউ চাপা সুরে বলল, আজকের দিনে খেতে হয় না। আমি অবাক হলাম। কেন? সে বলল, তুমি বুঝবে না। আমি ভাবলাম, হয়ত বমি বেশি হচ্ছে। তাই খেতে চাচ্চে না। ব্রাশ করতে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে এসে নাস্তা করতে বসলাম। বউকে বললাম, আমার পাশে বস। আমি খাইয়ে দেই। বউ বলল, আজকের দিনে বসা মানা। আমি কিছু বলতে যাবো, তখনি বাবা এসে হাজির! তারিন, দেখে যাও কত সুন্দর মাছ আনছি। বউ মাশাল্লাহ বলে দা আর থালা নিয়ে এলো মাছ কুটবে। যেই না বসেছে ওমনি মায়ের ধমক, বউ! তোমাকে না কতবার বলেছি, আজকে কিছু কাটাকাটি করবে না। বউ উঠে দাঁড়িয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়াতে গেলো। ভাবি বললেন, এভাবে দাঁড়িয়ো না তারিন। সোজা হয়ে দাড়াও। এখন আর আমি চুপ করে থাকতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কি হইছে! ওর সাথে এমন করতেছো কেন? মা বললেন তুমি বুঝবা না। আমি এবার আর অবাক না হয়ে রাগ করে জিজ্ঞেস করলাম, কি এমন কথা যা বুঝবো না। বুঝিয়ে বলো। বউ হাত ধরে টেনে নিয়ে রুমে চলে এলো। বললো, আজ সূর্য গ্রহণ তুমি জানো না! এই দিনে প্রেগনেন্ট মেয়েদের অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। যতক্ষণ গ্রহণ থাকে কিছু খেতে হয় না, কিছু কাটতে হয় না, বসা যায় না। এতে বাচ্চার ক্ষতি হয়। আমি যেনো আকাশ থেকে পড়লাম, বললাম, এসব আমি জানি না কে বললো! এগুলা যে কুসংস্কার এটা আমি চার বছর আগে থেকে জানি। বউ বললো, কিয়ের কুসংস্কার। আজীবন মানুষ এগুলা মেনে আসছে। আর যারা মানেনি তাদের বাচ্চার ক্ষতি হয়েছে। আমি বললাম, আরে গাধা, যা কুরআনে নেই, হাদিসে নেই ইভেন বিজ্ঞানেও এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। সেটা মানুষের মনগড়া কুসংস্কার ছাড়া আর কি? জানো এই বিষয়ে কুরআন হাদিস কি বলে? চন্দ্র, সূর্য বা অন্যকোনো সৃষ্ট বস্তু অদৃশ্যভাবে কারও উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে- এ ধরনের বিশ্বাস রাখা যাবে না। এটা তাওহিদ পরিপন্থী বিশ্বাস। যে আল্লাহতায়ালা ও শেষ দিবসে বিশ্বাস রাখে, তার মনে রাখা উচিত, আল্লাহতায়ালার অসংখ্য নিদর্শনের মধ্যে চন্দ্র-সূর্যের গ্রহণও একেকটি নিদর্শন।
কেউ যদি চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ দেখে, তবে তার উচিত হলো হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ী কাজ করা ও বেশি বেশি করে ওই সময় আল্লাহকে স্মরণ করা।
সূর্যগ্রহণের সময় গর্ভবতী নারী বা কারও জন্য জাগতিক কোনো কাজ করা বা না করা নিয়ে কোনোরকম বিধি-নিষেধ নেই। এ ব্যাপারে যা প্রচলিত আছে, তা কেবলই কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাস। এসব মানলে কিংবা বিশ্বাস করলে মারাত্মক গোনাহ হবে।
বরং সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণকে আল্লাহতায়ালার কুদরতি নিদর্শন বলে বিশ্বাস করতে হাদিসে বলা হয়েছে। পুরুষদের মসজিদে জামাতের সঙ্গে সালাতুল কুসুফ (সূর্যগ্রহণের সময়) ও সালাতুল খুসুফ (চন্দ্রগ্রহণের সময়) আদায়ের জন্য বলা হয়েছে। এর বাইরে এতে কোনোরূপ বিধি-নিষেধ নেই।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছেলে ইবরাহিমের মৃত্যুর দিনটিতেই সূর্যগ্রহণ হরো। তখন আমরা সকলে বলাবলি করছিলাম যে, নবীপুত্রের মৃত্যুর কারণেই এমনটা ঘটেছে। আমাদের কথাবার্তা শুনে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, সূর্য এবং চন্দ্র আল্লাহর অগণিত নিদর্শনসমূহের মধ্যে দু’টি নিদর্শন। কারও মৃত্যু কিংবা জন্মগ্রহণের ফলে চন্দ্রগ্রহণ বা সুর্যগ্রহণ হয় না।’ –সহিহ বোখারি: ১০৪৩
সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ দ্বারা আল্লাহ তার বান্দাদের ভীতি প্রদর্শন করেন বলেও হাদিসে উল্লেখ আছে। যাতে মানুষ ঈমান ও আমলমুখি হয় এবং পাপাচার বন্ধ করে।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, একদা সূর্যগ্রহণ হলে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ভীত হয়ে মসজিদে প্রবেশ করে দীর্ঘ নামাজ আদায় করে বললেন, ‘এ হচ্ছে একটি নিদর্শন, যা আল্লাহ প্রেরণ করেন। এটা কারও মৃত্যু কিংবা জন্মের জন্য সংঘটিত হয় না; বরং এর দ্বারা আল্লাহ তার বান্দাদের ভীতি প্রদর্শন করেন। তোমরা যখন এর কোনো কিছু দেখবে তখন ভীত মনে তার (আল্লাহর) জিকির, দোয়া ও তার ক্ষমা প্রার্থনার দিকে দ্রুত গমন করবে।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম। বুঝতে পারছো? এবার শুনো বিজ্ঞান কি বলে!
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা – পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় যখন চাঁদ সূর্যকে সম্পূর্ণরূপে আড়াল করে ফেলে, তখন এর উজ্জ্বল জোতির্বলয় থেকে তড়িত্চৌম্বক বিকিরণ ঘটতে থাকে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, এই বিকিরণ সূর্যের আলোর তীব্রতার তুলনায় অত্যন্ত ক্ষীণ। তাই এই বিকিরণ ১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্ব পেরিয়ে, পৃথিবীর ঘন বায়ুমণ্ডল ভেদ করে এসে দর্শকের চোখে অন্ধত্ব সৃষ্টি করতে পারার কোনো সম্ভাবনা নেই।
তবে সূর্য পুরোপুরি আড়াল হয়ে যাওয়ার আগেই, অর্থাত্ আংশিক সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের উজ্জ্বল বিকিরণ চোখে পড়লে তাতে চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এমনকি এর ফলে অন্ধত্বও (eclipse blindness) দেখা দিতে পারে। তাই সরাসরি সূর্যের দিকে না তাকানোর নিয়মটি শুধু গর্ভবতী নারী নয়, বরং সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা – গ্রহণের সময় সূর্যের তেজ কমে যায়। এর ফলে, জীবাণুর প্রকোপ বেড়ে যায় খাদ্যের উপর। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। মনে করা হয়, গ্রহণের সময় এক প্রকার বিকিরণ ঘটে, যা খাবারকে বিষাক্ত করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এ সময় এমন কোনো ক্ষতিকারক বিকিরণ ঘটে না, যা খাবারে বিষক্রিয়া করতে পারে। তবে সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যরশ্মি পৃথিবীপৃষ্ঠে আসতে বাধা পায়। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা হঠাত্ বেশ কমে যায়। কম তাপমাত্রা ও সূর্যালোকের অভাবের কারণে খাবারে ক্ষতিকর জীবাণুর আক্রমণ হতে পারে বলে আশঙ্কা থাকে। তাই জীবাণুজনিত বিষক্রিয়া এড়ানোর জন্যে, সূর্যগ্রহণ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সমস্ত খাবার ফেলে দিয়ে নতুনভাবে খাবার তৈরি করাকে যৌক্তিক ভাবা যেতে পারে। যদিও বর্তমান সময়ে খাবার ফেলে দেওয়াকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা – অনেকে চন্দ্রগ্রহণ শুরুর নয় ঘণ্টা ও সূর্যগ্রহণ শুরুর বারো ঘণ্টা আগে থেকে উপবাস শুরু করে থাকেন। এ সময় উপবাসকারীরা রান্না করা খাবার ও পানীয় গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। আসলে গ্রহণের সময় এমন কোনো বিকিরণ ঘটে না, যা খাবারকে নষ্ট বা বিষাক্ত করতে পারে এবং গ্রহণের সঙ্গে অশুভ কোনো কিছু ঘটারও সংশ্লিষ্টতা নেই। তাই এসময় খাওয়া ও পান করা থেকে বিরত থাকার আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।
চিকিত্সকদের মতে, বর্তমানে খাবার বেশিরভাগ সময় রেফ্রিজারেটরে থাকে। এর ফলে ক্ষতির কোনও ভয় থাকে না।
এসব নিষেধাজ্ঞা না মানলে গর্ভস্থ শিশু ঠোঁটকাটা বা তালুকাটা অবস্থায় জন্মগ্রহণ করবে, এমন একটি কুসংস্কার ভারতে প্রচলিত রয়েছে। আবার মেক্সিকোতে ঠিক উল্টোটা ঘটে। সেখানে গ্রহণের কুপ্রভাব থেকে শিশুকে রক্ষা করার জন্য গর্ভবতী নারীরা ধাতব অনুষঙ্গ (যেমন- সেফটিপিন) পরা, পেটের কাছে ছুরি ধরে রাখা, লাল রঙের অন্তর্বাস পরা- এসব নিয়ম পালন করে থাকেন।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা – প্রকৃতপক্ষে জন্মগত ঠোঁট বা তালু কাটার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ না পাওয়া গেলেও, বংশগত, পরিবেশগত কারণ কিংবা কিছু ঔষধ বা রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে এটি হতে পারে বলে জানা গিয়েছে। তবে সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সাথে শিশুর এধরনের ত্রুটি নিয়ে জন্মানোর ঘটনার সম্পর্ক নিয়ে কোনো বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
মানব ভ্রূণের ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম সপ্তাহ বয়সে তার নাক, মুখের তালু এবং ঠোঁট তৈরি হয়। কোনো কারণে দু’পাশের অংশগুলো মাঝে এসে মিলিত হতে বাধা পেলে ঐ অংশে ফাঁকা থেকে যায়। তখন একে আমরা ঠোঁটকাটা বা তালুকাটা বলে থাকি। এর সঙ্গে গ্রহণের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা – গর্ভে শিশুকে রেখে চিত হয়ে শোয়াটা মায়েদের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই একজন গর্ভবতী মহিলা অন্য সময়ে যেভাবে চলাচল করেন বা শুয়ে থাকেন, গ্রহণের সময়েও ঠিক সেভাবেই চলতে পারবেন। তার শিশু তার জরায়ুর ভেতরেই সুরক্ষিত আছে। সুতরাং বিকলাঙ্গতা ঘটানোর মতো অন্য কোনো কারণ না থাকলে, কেবলমাত্র গ্রহণের প্রভাবে শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মগ্রহণ করবে এমন আশঙ্কা করাটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক।
গর্ভস্থ শিশুর উপর গ্রহণের প্রভাব সম্পর্কে প্রচলিত বিশ্বাসগুলির পরিপ্রেক্ষিতে বৈজ্ঞানিকভাবে শক্ত কোনো প্রমাণই নেই। তাই এসব ক্ষেত্রে কোনোরকম কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেওয়াটা নিছক বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। সুতরাং গর্ভাবস্থায় গ্রহণ দেখা দিলে এ নিয়ে উত্কণ্ঠিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। বুঝতে পারছো??
বউ বলল, বুঝলাম। আমি বললাম তাইলে এবার রোজা ভেঙে সোজা হয়ে বসো। বউ বলল, অনেকেই তো আজ আমার মতো করে আছে, তাদের জানাতে হবে না!
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?