গল্পঃ গ্রীস্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া

গল্পঃ গ্রীস্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া।

©মারুফ হুসাইন। ২য় পর্ব।

শরীফুল মোবাইলটা বের করে টাইম দেখে, প্রায় তিনটা বাজে৷ আফজাল সাহেবের বাসায় একটার আগে আগে গিয়েছিল৷ প্রায় ঘন্টাখানেক সেখানে ছিল। পুরোটা সময় যেমন-তেমন কেটেছে৷ কিন্তু বের হওয়ার সময় তার সব কিছুই কেমন উলটপালট হয়ে গেল।

আফজাল সাহেবের বাসা থেকে বের হয়েছে, এক ঘন্টা হয়ে গেছে। এক ঘন্টা ধরে সে হাঁটছে৷ কিন্তু সময় কিভাবে চলে গেল সে বুঝতেই পারেনি৷ শান্তিবাগ থেকে কাকড়াইল, রমনা হয়ে শাহবাগ পৌছে গেছে৷ বাসায় যাওয়ার ইচ্ছা ছিল৷ কিন্তু এখন আর যেতে ইচ্ছে করছে না৷ ভাবছে, রমনায় গিয়ে বসে থাকবে।

লেক থেকে একটু দূরে ছাউনির নিচে একটা বেঞ্চে শরিফুল শুয়ে পড়েছে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়েই কোনো পার্কে ঢুকে বেঞ্চের উপর শুয়ে থাকার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দু বছর তার জীবন খুব গোছানোই ছিল। তারপর তৃতীয় বর্ষে হুট করে তার জীবনে এক ঝড় আসল৷ সে ঝড়ে তার পুরো জীবন উলটপালট হয়ে যায়৷ সে থেকেই এই অভ্যাসটা গড়ে উঠেছে৷ মন ভালো না থাকলেই সে কোনো পার্কে চলে যায়। বেঞ্চে শুয়ে থাকে। গাছের পাতা গুণে। বাতাসে গাছের পাতাগুলোর কেপে উঠতে দেখে। বাতাসে দুয়েকটা পাতা ঝরেও পড়ে। বাকিগুলো গাছের ডাল ধরে ঠিকই ঝুলে থাকে৷ তখন নিজেকে এই ঝরে যাওয়া পাতাগুলোর মতো মনে হয় তার।

‘ভাইয়া!’

শরিফুলের চোখ লেগে আসছিল৷ কারো ডাক শুনে আবার চোখ খুলে তাকায়, মেয়েটা তার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে ডাকছে। সে উঠে বসে, ‘কিরে রতনা তুই এখানে?’

‘ফুল বেচতে আইলাম৷’

‘আজ ক’টা ফুল বেচলি?’

‘এহনো তো কেউ আওয়া শুরু করে নাই। মানুষজন আইলেই না বেচা

অইব।’ বলে রতনা থেমে আবার যোগ করে, ‘আপনে এনে আইয়া শুইয়া আছেন কেন?’

‘এমনিরে!’ বলে শরিফুল মেয়েটার হাত বুলিয়ে দেয়, ‘যা তুই তোর বেচাকেনা কর।  কাল পড়তে চলে আসবি!’

‘আইচ্ছা ভাইয়া!’ বলে রতনা চলে যায়।

মেয়েটা কাওরান বাজারের বস্তিতে থাকে। সপ্তাহে তিন দিন সে কাওরান বাজারের বস্তিতে পড়াতে যায়৷ কাওরান বাজারের বস্তিতে পড়ানোর উদ্যোগটা সে, নাফিজ, মাহফুজা, জায়েদ মিলে নিয়েছিল। বছর না ঘুরতেই একে একে সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে৷ সে একাই এখনো সেখানে পড়িয়ে যাচ্ছে৷ তবে তারা সময় দিতে না পারলেও নিয়মিত খোঁজ-খবর নেয়৷

শরিফুল আবার ঘড়ি দেখে। সাড়ে চারটা বাজে। পাঁচটায় মগবাজারে তার একটা টিউশনি আছে৷ এখন হাঁটতে শুরু করলে টাইম মতো পৌছাতে পারবে কিনা মনে মনে হিসেব কষে নিল।

‘স্যার! স্যার!’

‘হে বলো!’ ছাত্রের ডাকে শরিফুলের ভাবনায় ব্যঘাত ঘটে। অর্ণবকে অংক করতে দিয়ে সে অন্য মনস্ক হয়ে গিয়েছিল, ‘শেষ হয়েছে? দেও দেখি।’

‘না স্যার! শেষ হয়নি৷ আপনাকে কেমন কেমন লাগছে। কী হয়েছে স্যার?’ শরীফুলকে অন্য মনস্ক দেখে তার ছাত্র জিজ্ঞাসা করে৷

‘কিছু হয়নি৷ তুমি অংক কর।’ সে সকালের ব্যপারটা ভুলতে পারছে না। ঘুরে-ফিরে তার চিন্তায় এসে ভর করছে৷ পড়াতেও ভালো লাগছে না, ‘অর্ণব!’

অর্ণব লেখা থামিয়ে শরিফুলের দিকে তাকায়, ‘জি স্যার!’

‘আজ আর পড়াব না।’ বলে সে উঠে পড়ে৷

গেটের দিকে এগিয়ে যেতেই অর্ণব তাকে ডাক দিয়ে বলে, ‘স্যার! আম্মু আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে বলেছে।’

শরিফুল দাঁড়িয়ে পড়ে৷ মিনিট পাঁচেক পর অর্ণবের মা এসে একটা খাম ধরিয়ে দেয়, ‘এই মাসে একটু লেট হয়ে গেল ভাই!’

শরিফুল আজকের তারিখ মনে করার চেষ্টা করে। মাস শেষ হতে এখনো বেশ কয়েক দিন বাকি, ‘ছিঃ আপা কী বলেন!’

খামটা হাতে পেয়ে শরিফুল বেশ স্বস্তি পায়। পকেট ইতিমধ্যে খালি হয়ে গেছে৷ এখন টাকাটা না পেলে বেশ ঝামেলায় পড়তে হতো৷ অবশ্য সে জানত দুয়েকদিনের মধ্যেই এই টাকাটা পেয়ে যাবে৷ সে অর্ণবকে দেড় বছর ধরে পড়াচ্ছে৷ এবার সে এসএসসি পরীক্ষা দিবে৷ এই দেড় বছরে কখনোই অর্ণবের মা মাস শেষের অপেক্ষা করেননি৷ একদম শুরু থেকেই মাস শেষ হওয়ার বেশ আগেই বেতনটা দিয়ে দিয়েছেন৷

অর্ণবদের বাসা থেকে নেমে শরিফুল মেসে ফিরে যাবে কিনা, ভাবছে৷ যেতে ইচ্ছে করছে আবার করছে না৷ রাস্তার পাশ ঘেষে হাঁটতে তার মন্দ লাগছে না৷ একটা সময় মুনার সাথে উদ্দেশ্যহীনভাবে কত সন্ধ্যা এসব ফুটপাত ধরে হেঁটে বেরিয়েছে। যা এখন শুধুই সুখ স্মৃতি।

মুনাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে শরিফুল মেসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তখন তার ফোন বেজে উঠে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পকেট থেকে মোবাইল বের করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র সা’আদের ফোন, ‘শরিফ ভাই! কেমন আছেন?’

‘ভালো, তুই কেমন আছিস?’

‘এই তো ভাই ভালো।’ কোনো ভণিতা না করে সা’আদ তার আসল কথায় চলে যায়, ‘ভাই! আপনি লাস্ট কবে রক্ত দিয়েছেন?’

‘কেন লাগবে নাকি?’

‘হ্যাঁ ভাই। কাল দুপুরে লাগবে। ল্যাবেইডে’

‘ঠিক আছে। আমাকে ডিটেইলস মেসেজ করে দে৷ আমি চলে যাব।’

‘আচ্ছা, ভাই। আমি মেসেজ করে দিচ্ছি৷’ বলে সা’আদ ফোন রেখে দেয়।

কাকে, কী কারণে রক্ত দিতে হবে? শরিফুল এসব জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনবোধ করে না। সা’আদ রক্তদান নিয়ে বেশ এক্টিভ। সে পুরাপুরি নিশ্চিত না হয়ে  তাকে ফোন দিবে না। এছাড়া তার রেয়ার গ্রুপ। এ নেগেটিভ। রক্ত দেয়ার সময় এসে গেলে না করার কোনো উপায় থাকে না।

মেসের কাছাকাছি আসতেই শরিফুল ফোনে আবার কল আসে। আননোন নাম্বার। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে, ‘আসসালামু আলাইকুম। ভাইয়া!’

শরিফুল সালামের উত্তর দেয়। 

‘সা’আদ ভাই আপনার নাম্বারটা দিয়েছে৷ বলল আপনি কাল ব্লাড দিচ্ছেন।’

‘হ্যাঁ।’

‘ঠিক আছে, ভাইয়া। আমার ফুফুর জন্য রক্ত লাগবে। আমি ঢাকার বাইরে আছি৷ তাই আমি আপনাকে রিসিভ করতে পারব না।’

‘ঠিক আছে, আমি চলে যাব৷ ওখানে কাকে পাব তার নাম্বারটা দিয়ে রাখুন। তাহলেই হবে।’ 

‘ভাইয়া! আপনার ঠিকানাটা দিন। আপনাকে নিয়ে আসার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হবে।’

‘বাংলা মটর এসে আমাকে ফোন দিলেই হবে।’

‘ঠিক আছে ভাইয়া। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’

ফোনের রিংটোনে শরিফুলের ঘুম ভাঙ্গে। কল রিসিভ করে কথা বলে সময় দেখে, সাড়ে বারোটা বাজে৷ তাকে নেয়ার জন্য গাড়ি পাঠানোর কথা ছিল। গাড়ি এসেছে৷ বাংলা মটরের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে৷

শরিফুল ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে যায়৷ বাংলামটর গিয়ে ড্রাইভারকে কল করে৷ তার দু হাত সামনেই গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল। ড্রাইভার নেমে তাকে রিসিভ করে গাড়ির সামনের দরজা খুলে দেয়। শরিফুল গাড়িতে উঠে বসে৷ ফ্রন্ট মিররে দিকে তাকাতেই পিছনে বসা মেয়েটার দিকে তার চোখ পড়ে৷ আকাশি রঙের স্কুল ড্রেস পরা মেয়েটাকে চিনতে তার অসুবিধা হয় না৷ 

চলবে……..

বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?