গল্পঃ একটি সুসাইড কেস অতঃপর…(দ্বিতীয় পর্ব)
©মারুফ হুসাইন।
৪.
পুলিশ এসেছে। লাশ শনাক্ত করা হয়েছে৷ ওসি সজিবের লাশ৷ আমার ঠিক বুঝে আসছে না, সজিবকে কেউ কেনো এভাবে মারতে যাবে। এখানকার কোনো পুলিশও কিছু বলতে পারছে না৷ সেদিন সজিবের সাথে থাকা কন্সটেবলকে ডেকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘সজিব আমার কাছে কি লুকিয়েছিলো?’
কন্সটেবল আমাকে কিছুই বলল না। কথা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। অনেক বার জিজ্ঞাসা করেও কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। আমার মনে হতে লাগলো, সজিবের খুন হওয়ার সাথে ঐ কাহিনির কোনো সম্পৃক্ততা আছে৷ আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এই কেসটা তদন্ত করার জন্য উপর মহল থেকে পারমিশন নিবো। এই এলাকা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের আওতাধীন৷ তাই আশা করি কেসটা আমার পেতে বেশী বেগ পেতে হবে না৷
পুলিশ লাশ নিয়ে গেছে৷ একজন এসআইকে দেখেছি আশে পাশের লোকদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে৷ তবে দেখে মনে হলো, সে তেমন কোনো ইনফরমেশন পায়নি৷ আমি উক্ত এসআইকে নিজের পরিচয় দিয়ে সজিব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম৷ কিন্তু সে আমাকে কোনো তথ্য দিতে অস্বীকার জানায়।
মার্ডার স্পট থেকে যখন বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম, তখন প্রায় এগারোটা বাজে৷ মোবাইলে তাকিয়ে দেখি, সালেহার বারোটা মিসডকল উঠে আছে৷ আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না, আজ কপালে শনি আছে৷ আমি আসাদকে ডেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম৷ নদী পার হয়ে যেতে পনেরো-বিশ মিনিট লাগবে৷
মাঝি আরো লোক নিতে চেয়েছিলো। আমি তাকে ট্রলার ছেড়ে দিতে বললাম। ছেড়ে দিলো। আসাদ আমার সামনাসামনি বসে আছে, ‘হাবিবা সুসাইড করেছে কেনো? তুমি বলতে পারো?’ আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘না। তেমন কিছু জানি না৷ তবে শুনেছি শাহেদ ভাইয়ের সাথে বলে তার কি সম্পর্ক ছিল। এই নিয়া হাবিবার বাবার সাথে চেয়ারম্যানের হট্টগোলও হয়েছে৷’
‘কি ধরণের হট্টগোল?’
‘তা ভাইয়া আমি বলতে পারবো না। শুনেছি হাবিবার বাবা তার বাড়ি গিয়ে চেঁচামেচি করেছে৷ তখন চেয়ারম্যান নাকি হাবিবার বাবাকে থ্রেড দিয়েছে।’
‘কি ধরণের থ্রেড?’
‘বলেছে, এই বিষয় নিয়ে বেশী কাপঝাপ করলে ভালো হবে না৷’
‘বিষয়টা কি বলতে পারো?’
‘ঐ যে বললাম শাহেদ ভাই আর হাবিবার কি সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তা কতদূর গড়িয়েছে। সেটা আমি জানি না৷’
৫.
আমাকে দেখেই সালেহা চেঁচিয়ে উঠলো, ‘সারাক্ষণ কোথায় ছিলে? মাছ ধরার নাম করে উনি রাজ্য উদ্ধার করতে চলে গেছেন? মাছ কোথায়?’
‘মাছ পাইনি।’
‘তাহলে এতোক্ষণ কি নদীতে বসে নদী পাহারা দিয়েছেন?’
‘আরে বাবা! সকালেই চলে আসতাম৷ ঐ পাড়ে একটা খুন হয়েছে। সেটা দেখতেই গিয়েছিলাম।’
‘সারা বছর তো খুন-খারাপি নিয়াই থাকো। এখন একটু এসবের কাছে না ঘেষলে হয় না।’ রাগে ফুঁসফুঁস করতে করতে সালেহা বলল।
তখনি শাশুড়ি মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘কিরে সালেহা এমনে চেঁচামেচি লাগায় দিসস কেন?’
আমি তখন সুযোগ পেয়ে বললাম, ‘আম্মা দেখসেন, সবসময় আমার সাথে এমন করে৷ একটুও শান্তি দেয় না৷’
‘আমি তোমারে একটুও শান্তি দেই না? এবার ঢাকায় চলো শান্তি কারে কয় তোমারে বোঝায় দিবোনে! এখন তো কিছু কইলেই শাশুড়ির কাছে বিচার দিবা!’
‘আহা কি শুরু করলি তুই! জামাইটা আমার কতো ভালো। হাজারে খোঁজলেও এমন একটা জামাই পাওয়া যায় না।’ শাশুড়ি সালেহাকে ধমক দিয়ে বললেন।
আমি শাশুড়ির দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললাম, ‘দেখলেন আম্মা! আমারে কি বলছে! আপনার সামনেই এগুলো বলছে। আপনি না থাকলে বুঝেন আমার কি অবস্থা করে৷’
খাওয়া-দাওয়া করে ফ্রেশ-ট্রেশ হয়ে বসকে ফোন দিলাম। অফিসে এই খুন নিয়ে হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে। কেসের তদন্ত করার জন্য কাকে পাঠাবে তা নিয়ে মিটিং চলছে। তাকে আমি অনুরোধ করলাম, কেসটা যেনো আমাকে দেয়া হয়। আমি ছুটিতে আছি বলে আমাকে দিতে প্রথমে রাজি না হলেও পরে বলল যে উপর মহলে কথা বলে দেখবে। বিকালে আমাকে ফোন দিয়ে জানানো হবে, কি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে৷ কথা শেষ করে ফোন রাখতেই দেখি চোখ গরম করে দরজার সাথে সালেহা দাঁড়িয়ে আছে। আমি ফোন রাখতেই দরজা লাগিয়ে হুরমুর করে ভিতরে এসে আমার কলার চেপে ধরে বলল, ‘ছুটি নিসস? এখনো তোর বাল-ছাল নিয়া থাকতে হইবো? বউ পোলাপাইনরে একটু সময় দেয়া যায় না?’
আমি সালেহাকে বুঝানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু সে বুঝতে নারাজ। তার কথা একটাই এখন ছুটিতে আছি, ফ্রি থাকতে হবে। এইসব নিয়া ছোটাছুটি করা যাবে না। আমি তাকে টান দিয়ে কাছে টেনে এনে ঠোঁটে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘দেখো! সজিব আমার বন্ধু মানুষ। এছাড়াও ওর খুন হওয়ার সাথে তোমাদের হাবিবার মৃত্যুরও যোগ-সূত্র আছে৷ তাই কেসটা ভালোভাবে দেখা আমার দায়িত্ব মনে করছি। তাই এটা আমি নিতে চাচ্ছি।’
সালেহার রাগ কমলেও আমাকে ছেড়ে দিয়ে মুখ ফুলিয়ে খাটে বসে পড়লো। আমি তার পাশে বসে বললাম, ‘শুনো! এই কেসটা নিলে একটা সুবিধাও আছে। শুনবে কি সেটা?’
‘আমার কোনো সুবিধা-ফুবিধা লাগবে না। থাকো গা তুমি তোমার কেস নিয়া!’
‘আরে শুনো না!’ আমি সালেহার চোয়ালে ধরে আমার দিকে ফিরিয়ে বললাম।
সালেহা মুখ আবার অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলো, ‘বলতে থাকো আমার কান খোলা আছে৷ আমি শুনছি।’
‘আহা সোনা! রাগ করে আছো কেনো?’ আমি আবার তার চোয়াল ধরে আমার দিকে ফেরানের চেষ্টা করলাম, ‘ শুনো না!’
‘শুনছি তো তুমি বলো!’
‘এই কেসটা যতদিন চলবে ততদিন আমরা এখানেই থাকতে পারবো। আর যাও কেসটা শেষ হওয়ার পর তোমাদের সবাইকে নিয়ে বান্দরবন ঘুরতে যাবো।’
সালেহা ঘুরে বসে ঠোঁটগুলো দুই দিকে প্রসারিত করে সুন্দর করে একটা হাঁসি দিলো, ‘সত্যি তো?’
‘হ্যাঁ সোনা! সত্যি যাবো।’
সালেহা উঠে আমার বরাবর দাঁড়িয়ে আঙুল দেখিয়ে রাগি রাগি ভাব নিয়ে বলল, ‘যদি কথা না রাখো তাহলে দেখবা তোমার খবর আছে।’
৬.
বিকেল দিকে বস ফোন দিয়ে জানালেন, কেসের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে। বাকি যত ধরণের সহযোগীতার প্রয়োজন তা যেনো স্থানীয় থানা থেকে নিয়ে নেই। থানায় লেটার ফ্যাক্স করে দেয়া হবে৷ কাল থানায় হাজিরা দিয়ে যেনো আমার কাজ শুরু করি। এই কেসটা পুলিশের মান-সম্মানের ব্যাপার। তাই যেনো কোনো গাফলতি না করা হয়। এই কেস সমাধান করার জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা আমাকে দেয়া হয়েছে৷ যেভাবেই হোক খুনির ধরা পড়া চাই।
আমি আসাদকে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে হাবু ভাইয়ের বাড়িতে যাই। আমাকে দেখে হাবু ভাই চেয়ার এগিয়ে বসতে দেয়। তার অবস্থা বেশী ভালো নয়। মেয়ের মৃত্যুতে পুরাপুরি ভেঙ্গে পড়েছে৷ আমি তাকে সান্ত্বনা দিতেই সে কান্না জুড়ে দিয়ে বলে, ‘আমার মেয়েডা নিজে নিজে মরে নাই৷ ওরা চেয়ারম্যানের পোলায় মারসে।’
আমি হাবু ভাইকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। কান্না থামতেই বললাম, ‘হাবু ভাই! টেনশন কইরেন না৷ আপনার মেয়ের খুনি বাঁচতে পারবে না। আমি এখানে এসেই আপনার মেয়ের মৃত্যুর কথা শুনেছি। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসেছিলাম৷ কিন্তু আপনার মেয়ের কথা শুনে এই ছুটি কেন্সেল করে কেসটা হাতে নিয়েছি। আপনার মেয়ের খুনি বাঁচতে পারবে না। কি হয়েছিলো আপনি আমাকে খুলে বলুন!’
‘আমার মেয়েটা বাচ্চা মানুষ। ওরে চেয়ারম্যানের পোলায় ফুসলিয়ে ওর সর্বনাশ করেসে। এইটা যখন আমি তারে বলতে গেলাম, তখন সে আমারে হুমকি-ধমকি দিতে লাগল।’ হাবু ভাই কাঁদতে লাগলেন। মিনিট খানেক কেঁদে চোখ মুছে বললেন, ‘এর দুই দিন পর মাইয়াডাতে মাইরা পানিতে ফালায় দিসে। আমি কইসিলাম আমার মাইয়ারে ওর পোলার লগে বিয়া না দিলে ওর পোলারে জেলের ভাত খাওয়ামু! এইডাই আমার অপরাধ হইয়া গেসে। আর অয় আমার মাইয়াডারে মাইরা ফেলল।’
‘কিভাবে মেরেছে?’
‘মাইয়াডায় বিকালে পড়তে গেসিলো। এরপর আর ফিরা আহেনি। অনেক সন্ধ্যা হইয়া যাওয়ার পরও ফিরা আসতেসিলো না। এল্লিগা আমি সন্ধ্যাবেলা খুঁজতে বাইর হই। কোথাও না পাইয়া মাস্টারের বাড়িতে যাই। মাস্টারও কয় পইড়া অনেক আগেই চইলা গেসে। মাস্টারের বাড়িরতে ফিরা আহোনের সময় দেহি পুকুরে আমার মাইয়াডা মইরা ভাসতেসে।’
‘কোন পুকুরে?’
‘মাস্টার বাড়িরতে একটু সামনে যেই পুকুরটা ঐডা।’
‘আচ্ছা হাবু ভাই! আমি আসি এখন। কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন।’
‘কিছু খাইয়া যান আপনে।’
‘না ভাই আজকে না। আপনার মেয়ের খুনিকে ধরতে পারলে পেট ভরে খেয়ে যাবো।’
হাবু ভাইয়ের বাড়ি থেকে বের হয়ে একটা চায়ের দোকানে বসলাম, ‘আসাদ! মাস্টারের বাড়িটা কোথায়?’
‘এখান থেকে যেতে দশ মিনিট লাগে। যাবেন এখন?’
‘না আজ নয়৷’ ঘড়ির দিকে তাকালাম। আটটা বাজে। ঢাকায় এই সময় সন্ধ্যা হলেও গ্রামে মোটামুটি রাত, ‘অনেক রাত হয়ে গেছে৷ আচ্ছা মাস্টারের নাম কি?’
‘এখন তো হাদি ভাই পড়ায়৷ জহির স্যারের বয়স হয়েছে৷ তাই আর পড়ান না। জহির স্যার নামে স্কুলের হেড মাস্টার। কিন্তু কাজ-কাম সব হাদি ভাই দেখাশোনা করে। এলাকার ছেলেমেয়েরা এখন হাদি ভাইয়ের কাছেই টিউশনি পড়ে।’
‘আচ্ছা এই হাদি ছেলেটা কেমন?’
‘ভাই ও তো ছেলে হিসেবে অনেক ভালো। কোনো বদনাম নেই। এলাকার সবাই তাকে জহির স্যারের যোগ্য উত্তরসূরী ভাবছে।’
চা শেষ করে বিল মিটিয়ে দিলাম, ‘চলো এখন বাড়ি যাওয়া যায়।’
আমি আর আসাদ বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলাম। কুচকুচে অন্ধকার রাত। ঝি ঝি পোকা সহ হরেক রকম পোকার ডাকে কান ভারি হয়ে আসছে, ‘আসাদ!’
‘হ্যাঁ ভাইয়া!’
‘তোমার কি মনে হয়?’
‘কি ব্যাপারে?’
‘হাবিবার ব্যাপারে৷ ও আত্নহত্যা করেছে নাকি কেউ মেরেছে?’
‘ভাইয়া! আমি ওরে যতটুকু চিনি ও আত্নহত্যা করার মেয়ে নয়।’
‘তাহলে কে মেরেছে বলে মনে হয়?’
‘চেয়ারম্যানের পোলায় ছাড়া এই সাহস আর কে দেখাবে!’
আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। চুপচাপ হাঁটতে থাকলাম।
‘ভাইয়া! একটা কথা বলি?’
‘হুম বলো!’
‘আপনি চেয়ারম্যানের পোলারে ছাইড়েন না৷ ওর জ্বালায় গ্রামের একটা মেয়েও শান্তিতে থাকতে পারে না।’
‘ছাড়বো না ওরে! এখন এসব কথা বাদ দেও। বলো তোমার পড়ালেখার কি অবস্থা?’
‘ইন্টারমিডিয়েট শেষ করার আগেই ছেড়ে দিয়েছি। এখন বাবার সাথে খেত-খাবারের দেখাশোনা করি।’
‘পড়ালেখা ছাড়লে কেনো?’
‘আব্বার বয়স হয়েছে৷ একা কুলিয়ে উঠতে পারেন না৷ তাই তার সহযোগিতা করছি।’
‘পড়ালেখাটাও চালিয়ে গেলে পারতে।’ ততক্ষণে বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি। আসাদ চলে যেতে চাইলে রাতের খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য তাকে রেখে দিলাম।
চলবে…….