একটি নতুন কেস এবং ফেরা অতঃপর…(প্রথম পর্ব)
©মারুফ হুসাইন।
১.
কী করা যায় ভেবে আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। সালেহার সাথে মাত্রই সম্পর্ক ঠিকঠাক হতে শুরু করেছে। দেড় বছর আগের ঐ ব্যপারটা সে ভুলে যেতে শুরু করেছে। এখনি যদি গিয়ে বলি, একটা ভয়ংকর কেস সল্ভ করার জন্য আমাকে অফিসে জয়েন করতে বলা হচ্ছে। তাহলে ব্যাপারটা কি সে স্বাভাবিকভাবে নিবে নাকি পুলিশে আবার জয়েন করছি, বলে আমার সাথে ঝগড়া-ঝাটি শুরু করবে।
সকালে ফোন দিয়ে হুট করে ডিআইজি স্যার আমাকে জরূরী দেখা করতে বললেন। আমি তার সাথে দেখা করতে অফিসে চলে গেলাম। তিনি আমার জন্য চা আনিয়ে বলতে লাগলেন, ‘আমাদের তোমাকে জরূরী দরকার। তাই এভাবে ডেকে আনলাম।’
‘কী দরকার স্যার?’
‘আমাদের অফিসাররা একটা কেস সল্ভ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এখন আমার আশা একমাত্র তুমিই।’
‘স্যার! জানেনই তো, আমি নিজেকে এসব থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছি। এই কাজের জন্য আমার ব্যক্তিগত লাইফে অনেক অশান্তি গেছে। আমি আর অশান্তি বাড়াতে চাই না।’
‘তুমি আরেকবার ভেবে দেখো! এটা আমাদের সম্মানের ব্যাপার। কেসটা সল্ভ করতে না পারলে আমাদের সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। আমাদের দিকে সবাই আঙ্গুল তুলে হাসবে।’
‘স্যার আমি ভেবে দেখি। আমি চাচ্ছি না, আমার ব্যক্তিগত জীবনে আবার অশান্তি নেমে আসুক’ বলে ডিআইজি স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে আসলাম।
সালেহাকে কীভাবে বুঝানো যায়, ভাবতে ভাবতে অফিস এরিয়া থেকে বের হয়ে আসছিলাম। তখন কারো ডাকে পিছনে ফিরে দেখি, জোরে হেঁটে আরিফা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটা গোয়েন্দা বিভাগে জয়েন করার পর বেশ কিছু কেসে আমার সাথে কাজ করেছে। বেশ বুদ্ধিমতি মেয়ে। তাকে কোনো কাজ দিলে বেশ গুছিয়ে এবং মনোযোগ সহকারে শেষ করে দেয়। সেখানে কোনো খুত থাকে না। এমনও কেস গেছে, যেটা তার জন্যই সমাধান করতে পেরেছি। সে না থাকলে হয়তো ওই কেসগুলো সমাধান করতে পারতাম না। আরিফা আমার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল,
‘স্যার! আপনি এখানে?’
‘চাকরী ছেড়ে দিয়েছি বলে আসতে পারি না?’
‘তা কেন পারবেন না!’ বলে একটু থেমে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছেন স্যার?’
‘এইতো আছি। তোমার দিনকাল কেমন চলছে?’
‘চলছে স্যার! আপনার সাথে কাজ করে যে আনন্দটা পেতাম। এখন আর সেরকম আনন্দ পাই না। কাজ কেমন পানসে পানসে লাগে।’
আমি মুচকি হাসলাম, ‘কাজ করতে থাকো। দেখবে ইন্টারেস্টিং কেস হাতে পেলে ঠিকই আনন্দ পাচ্ছো।’
‘স্যার! আগামী মাসে আমার বিয়ে। আপনাকে…..’
‘নতুন জীবনের জন্য তোমাকে শুভ কামনা।’ আরিফাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই আমি বললাম।
‘আপনার কিন্তু আসতে হবে স্যার!’
‘দেখা হয়ে গেল বলে বলছ! চাকরী ছেড়ে দিয়েছি বলে সালেহা, মাইশার সাথেও সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছ!’
‘মোটেও তা নয়। আপনি তো জানেনই আমাদের কত ব্যস্ত থাকতে হয়। ব্যস্ততার জন্যই যাওয়া হয় না। আপনি থাকতে তো কাজের উছিলাতে যাওয়া হতো। এখন গেলে আপনি কী ভাবেবন, ভাবিই বা কী ভাববে! আর আমি আপনাকে আগে থেকে দাওয়াত দেয়ার কথা ভাবছিলাম। আজ দেখা হয়ে যাওয়ায় ভাবলাম, বলে রাখি যেন পরবর্তীতে ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে মিস না করেন!’
‘আচ্ছা আমি তোমার বিয়েতে থাকব।’ আমি আরিফাকে বিদায় দিয়ে বেরিয়ে আসলাম।
২.
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে এসেছি। আসার পর থেকেই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম। কেসটা কী, তাও এখনো জানি না। তবে মনে হচ্ছে, কেসটা কোনো সহজ কেস নয়। যেটাতে ডিবির এতো এতো ইন্টেলিজেন্টরা ফেইল মেরেছে, সে কেস সহজ হওয়ার কথা নয়।
টেবিলে রাতের খাবার রেডি করে সালেহা আমাকে খাওয়ার জন্য ডাকল। আমি চুপচাপ খেতে বসে গেলাম। তার মধ্যে মেয়েটা এসে বায়না ধরল, বাবার তাকে খাইয়ে দিতে হবে।
‘আম্মু তোমাকে খাইয়ে দিবে মা!’ বলে আমি তাকে সরিয়ে দিলাম।
কিন্তু সে বাবার হাতেই খাবে। আমার বিরক্ত লাগছে। এখন এই আদিখ্যেতা করার মতো অবস্থা আমার নেই।
‘কী হয়েছে তোমার বলো তো! আসার পর থেকেই দেখছি, কী যেন চিন্তা করছো।’ সালেহা মেয়েকে কাছে টেনে নিতে নিতে বলল।
‘না, কিছু হয়নি তো!’ বলে আমি খাবারের দিকে মনোযোগী হলাম। সালেহা আর কথা বাড়াল না। ঐ ঘটনার পর আমাদের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল, তা কমে আসলেও সালেহার স্বভাবে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এখন আর সে আগের মতো উচ্চবাচ্য করে না। কথায় কথায় তর্ক শুরু করে না। কোনো কিছু বলতে হলে, খুব ঠান্ডা মাথায় বলে। ব্যাপারগুলো আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগলেও ভালো লাগে। মনে হয়, জীবনে শান্তি ফিরে এসেছে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে আমি বারান্দায় গিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরালাম। বেশ কিছুক্ষণ পর যখন দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরিয়েছি, তখন সালেহা বারান্দায় এসে আমার হাত থেকে সিগারেট টেনে নিয়ে বলল, ‘বলো তো কী হয়েছে? আসার পর থেকেই দেখছি, কেমন টেনশনে আছো। কী কী জানি ভাবছো!’ সে একটু কাছে এগিয়ে চেয়ারের হাতলে হালকা করে বসে আমার কাধে হাত রেখে বলল, ‘বলো কী হয়েছে?’
‘আজকে ডিআইজি স্যার ডেকেছিলেন।’
‘কেন?’
‘বললেন যে আমাকে তাদের দরকার। একটা ভয়ংকর কেস যা কেউ সল্ভ করতে পারছে না। তাই আমার সাহায্য দরকার!’
‘তুমি কী বললে?’
‘আমি তেমন কিছুই বলিনি। বলেছি যে ভেবে জানাব!’
‘তো কী ভেবেছ?’
‘আমার মনে হচ্ছে আমার তাদের সহযোগীতা করা দরকার। বলল, এটা আমাদের মানসম্মানের ব্যাপার।’
‘দেখো! তোমার এই চাকরী নিয়ে আমাদের মাঝে অনেক ঝামেলা হইসে। এইটা নিয়ে আমি আর ঝামেলা করতে চাই না। আমি না খেয়ে থাকতে রাজি। তবুও চাই না, জীবনের রিস্ক নিয়ে তুমি এই চাকরী করো। তুমি তোমার অফিসের মান-সম্মানের কথা ভাবছো। একবারো আমাদের কথা ভাবো না, এই চাকরীর জন্য তোমার কিছু হলে আমাদের কী হবে!’
‘কিন্তু আমার কিচ্ছু হবে না তো!’
‘দেখে এই ব্যাপার নিয়ে আমি তোমার সাথে আর তর্কে জড়াতে চাই না। তুমি খুন-খারাবির ঝামেলায় আর জড়াবে না ব্যস!’ বলে সালেহা উঠে চলে গেল।
৩.
ওদিনের পর সালেহার সাথে এই বিষয়ে আর কোনো কথা হয়নি। জীবন স্বাভাবিকভাবে চলতে লাগল। ডিআইজি স্যার একদিন ফোন দিয়ে আমার সিদ্ধান্ত জানতে চাইলেন। আমি না করে দিয়েছি। বলেছি, ‘স্যার! আমি আর আমার ব্যক্তিগত জীবনে অশান্তি চাই না। আর আমার ফ্যমিলি আছে। তারা আমার দিকে চেয়ে বেঁচে আছে।’
‘তুমি তোমার জীবনটাকেই বড় করে দেখলে! বাকিদের জীবনের কী কোনো দাম নেই!’
‘কিন্তু স্যার আমার কী করার বলুন, আমি আবার ওখানে গেলে সালেহা কষ্ট পাবে। সহ্য করতে পারবে না। এই মেয়েটাকে কষ্ট দিতে চাই না। তবে কাউকে না জানিয়ে যতটুকু সম্ভব আমি আপনাদের সহযোগীতা করব।’
‘আমার আর কিছু বলার নেই।’ বলে ডিআইজি স্যার ফোন রেখে দিয়েছিলেন।
বেশ কিছু দিন পর আরিফা আমার বাসায় এসে উপস্থিত হলো। সালেহার কাছে তার বিয়ের কার্ড দিয়ে বলল, ‘ভাবি! আপনারা কিন্তু অবশ্যই আসবেন। না আসলে কষ্ট পাব।’
সালেহা তাকে কথা দিল, আমরা যাচ্ছি সিউর। আরিফা আগেও বেশ কয়েকবার আমাদের বাসায় এসেছে। সালেহার সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক। আমার মেয়েটাকেও আরিফা খুব আদর করে। মাইশাও আরিফা আন্টি বলতে পাগল। সে আরিফাকে পেলে মা-বাবার কথা বেমালুম ভুলে যায়।
মাসের প্রায় শেষ। আরিফার বিয়ের আর দেড় সপ্তাহও নেই। সে অফিস থেকে এক মাসের ছুটি নিয়েছে। সে আমাদের সাথে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করতে বসল। খেতে খেতে সালেহা বলল, ‘আরিফা তোমার বরটাকে তো দেখালে না!’
‘বিয়ের আগেই একদিন দেখাব। ওকেসহ আপনাদের নিয়ে একদিন ডিনার করব।’
বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে। আমরা নিজেদের জন্য টুকটাক কেনাকাটা করলাম। আরিফার জন্য গিফট কিনে রাখলাম। আমাদের একদিন ওদের সাথে ডিনার করার কথা থাকলেও ব্যস্ততার জন্য আর ডিনার করা হয়ে ওঠেনি। আরিফার সাথে সালেহার নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। কীভাবে কী করতে হবে, তার জন্য গাইড করছে।
বিয়ের ঠিক দু দিন আগে সকাল সকাল সালেহা আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেল। আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলাম, টিভিতে খবর চলছে। হয়তো কোনো মার্ডার নিউজের খবর। এগুলা আমি দেখে-শুনে অভ্যস্ত। তাই সে খবর আমার নজর কাড়তে পারেনি। আমার চোখ গেছে সোজা মাইশার দিকে। মাইশা সোফার উপর বসে জোরে জোরে কাঁদছে। আমি সালেহার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী হয়েছে?’
সালেহা কেমন অদ্ভুতভাবে আমাকে টিভির দিকে তাকাতে ইশারা করল। আমি টিভির দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। আমি দৌড়ে বেডরুমের দিকে গেলাম। কিভাবে কী হয়েছে জানতে হবে, তাই বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা তুলে নিয়ে লক খুলতেই দেখলাম, আননোন নাম্বার থেকে কয়েকটা কল এবং একটা মেসেজ এসেছে। মেসেজ ওপেন করলাম, ‘স্যার প্লিজ হেল্প মি! আই এম ইন ট্রাবল’
চলবে………
একটি নতুন কেস এবং ফেরা অতঃপর…
©মারুফ হুসাইন