October 4, 2023

ইকারাস – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

 

“এই পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী হচ্ছে ভীত ও আতঙ্কিত মানুষ।
তারা বুঝে হোক, না বুঝে হোক ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে।”

সমুদ্রের মাঝে একটি দ্বীপ। সেই দ্বীপে তৈরি হয়েছে অত্যাধুনিক এক হাসপাতাল। সেখানে কাজ করার লোক খুঁজে বেড়ানো হচ্ছে। এভাবে খুঁজে পাওয়া গেল জহুর নামের একজনকে। যার জীবনের সব আলো নিভে গিয়েছে অনেকদিন। স্ত্রী-সন্তান হারানো জহুরের আর কোনো চাওয়া নেই। লোকে তাকে বাউন্ডুলে বলে। তা বলুক। এসব নিয়ে সে ভাবে না। জীবনের সব আশা ভরসা হারিয়ে গেলে ভাবনার কিছু থাকে না। সেই জহুরকে যখন হাসপাতালে কাজের প্রস্তাব দেওয়া হলো সে না করে দিলো। তার কিছুই করতে ভালো লাগে না। অত্যাধুনিক হাসপাতালে কাজ! লোভনীয় প্রস্তাব। তবুও আগ্রহ নেই জহুরের। তারপরও কী মনে করে হাজির হয়ে গেল সেই হাসপাতালে। কৌতূহল মেটাতেই যাওয়া। সেই সাথে ডক্টর কাদেরের সাথে দেখা করার আগ্রহ। কে এই ডক্টর কাদের? লোকে বলে, তার মতন দ্বিতীয় লোককে আর পাওয়া যাবে না। আসলেই?

হাসপাতালের তিনশ তেত্রিশ নম্বর কক্ষে একটি মেয়েকে দেখে থমকে দাঁড়ায় জহুর। দেখে মনে হয়, মেয়েটার মানসিক অবস্থা ভালো নয়। কেমন বিষণ্ণ, উদাস দৃষ্টি দু’চোখ জুড়ে। এই মেয়েটার কী হয়েছে, জানে না জহুর। তবুও মনের মধ্যে কেমন এক অনুভূতি হচ্ছে। কেন হচ্ছে? কিছু কি ঘটবে? তারই পূর্বাভাস?

জানা যায়, সেই হাসপাতাল শুধু হাসপাতাল নয়। এর পেছনে ভয়ংকর সব গবেষণা করেন ডক্টর কাদের। তার ফলশ্রুটিতে মিলিটারির হাতে বন্দী হয় সে। মানুষকে গিনিপিগ বানিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চাওয়া মানুষগুলো ভীষণ পাপী। তার গবেষণার ফল তিনশ তেত্রিশ নম্বর কক্ষের মেয়েটি। যার গর্ভে জন্ম নেয় ফুটফুটে এক শিশু। সেখান থেকেই যেন নতুন দিনের শুরু। সেই শিশুটির পিঠে বিশাল এক ডানা। পক্ষী মানুষ হিসেবে তার বেড়ে উঠতে হবে। কীভাবে সে বাঁচবে? পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে মা মারা যায়। যাওয়ার সময় ছেলেটিকে দিয়ে যায় জহুরের কাছে। জহুর নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে, এই ছেলেটিকে সে বাঁচিয়ে রাখবে। সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন দিবে। চাইলেই কি আর পারা যায়?

এমন শিশু, যার পিঠে বিশাল এক পাখনা। যা বড়ো হচ্ছে তার সাথেই। তাকে চাইলেই আড়াল করা যায় না। আর মানুষ জানতে পারলে খবর ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগবে না। কিছু অসৎ মানুষ জানতে পারলে বুলবুলের ক্ষতি ছাড়া উপকার করবে না। ও হ্যাঁ, বলা হয়নি। ছেলেটার নাম বুলবুল। গ্রীক পুরাণের চরিত্র ইকারাসের মতো। যে পাখা লাগিয়ে উড়ে যায়, যেন মনে হয় সূর্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই ইকারাসের মতো হয়ে সংগ্রামের জীবন শুরু হচ্ছে বুলবুলের। নিজেকে লুকিয়ে রাখা, বাঁচিয়ে রাখার অনন্ত প্রয়াস। ওদিকে ছুটে আসছে শত্রুপক্ষ। ধরতে পারলে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর এ আবিষ্কারকে কেটেকুটে দেখবে কী আছে এর মধ্যে। বুলবুল কি পারবে নিজেকে বাঁচাতে? শত্রুপক্ষের সংখ্যা অগণিত। ওদিকে বুলবুল একা, নিঃসঙ্গ। নিজের লড়াই নিজেকেই লড়তে হবে। এই লড়াইয়ে কাউকে পাশে পাবে না সে?

▪️পাঠ প্রতিক্রিয়া :

মুহম্মদ জাফর ইকবালের রচিত “ইকারাস” বইটি দেশীয় সায়েন্স ফিকশন ধারার অন্যতম সংযোজন। যদিও পাঠক সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। কিন্তু আমার বইটি ভালো লেগেছে। গ্রীক পুরাণের এক চরিত্র দিয়ে লেখক দেশীয় প্রেক্ষাপটে দারুণভাবে চিত্রায়িত করেছেন বইটি। সায়েন্স ফিকশনের সাথে ফ্যান্টাসি জাতীয় বইও বলা চলে।

লেখক এখানে ভালো ও খারাপের বিভেদ দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন বিজ্ঞান যেখানে আশীর্বাদ হওয়ার কথা সেখানে অভিশাপ হিসেবে নেমে আসে কারো কারো জীবনে। সেই জীবনটা পেয়েছে বুলবুল। এক পাগলাটে ডাক্তারের গবেষণার ফল ভোগ করতে হয়েছে তাকে।

লেখক তার বর্ণনা দিয়ে সুন্দরভাবে সবকিছু ফুটিয়ে তুলেছেন। সুন্দরবনের বর্ণনা দিয়েছেন। যেন চোখের সামনে ফুটে উঠেছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো ম্যানগ্রোভ বন। একা বেঁচে থাকার প্রয়াস কেমন হতে পারে “ইকারাস” বইটি তার অন্যতম দৃষ্টান্ত।

সহজ ও সাবলীল ভাষায় লেখা জাফর ইকবালের বইটি পাঠকের মস্তিষ্কে আঘাত করতে পারে। কিশোর বয়সীদের জন্য উপভোগ্য হলেও, এর ভেতরে থাকা শিক্ষার রস আস্বাদন করতে পারলে জীবনের সম্মুখভাগে এগিয়ে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই সহজ হবে।

আমরা মানুষরা সবচেয়ে খারাপ। সৃষ্টিকর্তা আমাদের “সৃষ্টির সেরা জীব” হিসেবে তৈরি করলেও আমরা তার কতটা মূল্যায়ন করতে পেরেছি? প্রশ্নটা থেকে যায়। অকারণে পশুপাখি মারা আমাদের বিনোদনের খোরাক। কিংবা বিস্ময়কর কিছু দেখলে তা কেটেকুটে দেখা যেন বিজ্ঞানের আশির্বাদ মনে করা হয়। অথচ যেই প্রাণের উপর পরীক্ষা করা হচ্ছে, সেই প্রাণেরও যে বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে, তা কেউ অনুধাবন করে না।

“ইকারাস” বইটি বিজ্ঞানের আশির্বাদ আর অভিশাপকে দুইভাগে বিভক্ত করেছে। দেখিয়েছে মানবিকতা কেমন হতে পারে। আবার এর উল্টোপিঠে রয়েছে স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষ, যারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য যত নিচে নামা যায় ততটা নামতে পারে।

▪️চরিত্রায়ন :

এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বুলবুল। গ্রীক মিথলজি থেকে ধার করা ইকারাসকে কল্পনা করে চিত্রায়িত চরিত্রটির জীবন কষ্টের। পিঠে ডানা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সহজ নয়। লুকিয়ে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন একটা কাজ। যেখানে বাঙালিদের কৌতূহলী স্বভাব সর্বত্র। আড়ালে থাকা বুলবুল তবুও একদিন সবার সামনে এলো। এরপর? জীবনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু সেখানে। জীবনের সাথে যুদ্ধ করা, প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করা, প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করা। সবকিছু জয় করে বেঁচে থাকতে হয়। আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলে। বাঁচার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য। তাদের এ লড়াই ঠিক বুলবুলের মতোই।

“ইকারাস” উপন্যাসে আমার প্রিয় চরিত্র জহুর। রক্তের সম্পর্ক না থাকার পরও কেবল কথা দিয়েছে বলে বুলবুলের মতো একজন বিস্ময়কর প্রাণী কিংবা মানুষকে নিজের মতো করে মানুষ করার সাহস দেখিয়েছেন। যেখানে ডক্টর কাদের, ডক্টর সেলিম কিংবা ডক্টর আশরাফরা সমাজের হর্তাকর্তা হয়েও বিজ্ঞানের নামে মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিয়েছে। বিজ্ঞান কি বলেছে, মানুষের ক্ষতি করে আমার গবেষণা করো? নাহ! তবুও মানুষ সেটিই করে। এসব গবেষণার কুফল ভোগ করতে হয় মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীকে।

এই সমাজে জহুরের মতো ঠাণ্ডা মাথার মানুষেরা সমাজে আছে বলেই হয়তো সমাজ টিকে আছে। মানবিকতার লড়াইয়ে হারিয়ে দিতে পারে সমস্ত অপশক্তিকে। কিন্তু সবসময় কি পারা যায়? একসময় নিঃশেষ হয়ে যেতে হয়। হেরে যেতে হয় প্রকৃতির কাছে। এরপর?

কিংবা মিথিলা বা লিপির মতো মানুষেরা আছে বলেও হয়তো আমাদের সমাজ এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বয়স হয়তো বেশি না, আকার আকৃতিতেও অন্যদের সাথে পাল্লা দেওয়া সম্ভবও নয়। তবে তাদের মধ্যে আছে বিশাল এক সাহসী মন। অন্যের উপকার করার তাড়না। বন্ধুর জন্য নিজেকে বিসর্জন দেওয়া এমন সাহসীদের জন্য এই সমাজ, এই দেশ এখনো পথভ্রষ্ট হয় না।

▪️পরিশেষে, “ইকারাস” এক বিস্ময়কর জীবন গাঁথা। কারো ভালো লাগে, কারো কাছে বানোয়াট গল্পের সমাহার। আমার ভীষন ভালো লাগার একটি বই। টুকরো টুকরো যেসব শিক্ষার উপকরণ লেখক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন, সেগুলো অনুভব করতে পারলে কিশোর বয়স থেকেই অনেক কিছু অনুধাবন করা যাবে।

▪️বই : ইকারাস
▪️লেখক : মুহম্মদ জাফর ইকবাল
▪️প্রকাশনী : সময় প্রকাশন
▪️ব্যক্তিগত রেটিং : ৪/৫

রিভিউ লেখক: Sakib

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *