এখন হয়েছে যশোর। দেশভাগ, মহকুমাগুলো জেলা হয়ে আকারও কমে গেছে। তখন ছিল যশোহর। জেলা নয় একটা দেশ। তারও আগে নাকি ছিল জসর। কিন্তু এই উপন্যাস ১৫৮৩ সালের যশোহর নিয়ে।
কথিত আছে, বিক্রমাদিত্য ও রাজা বসন্ত রায় গৌড়ের যশ হরণ করে এই শহরের শ্রীবৃদ্ধি করেছিলেন বলে স্থানীয় পুরাতন নাম জসর পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন নামকরণ হয় যশোহর। রাজা বসন্ত রায়ের মৃত্যুর যশোহরে একচ্ছত্র অধিপতি হন “THE KING OF THE SUNDARBANS”- মহারাজা প্রতাপাদিত্য।
কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্য বাংলা বারো ভূঁইয়ার এই প্রভাবশালীকে স্থানীয় রাজাকে অমর করে রেখেছেন। কিন্তু এই উপন্যাস শুধু প্রতাপাদিত্যকে নিয়ে নয়, তবে তিনি রয়েছেন অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানেই। সিংহাসনে।
প্রতাপাদিত্যের সময় বাংলার নৌপথে পর্তুগীজ জলদস্যুদের প্রচন্ড উৎপাত ছিল। আর লেখকে স্মরণজিৎ চক্রবর্তী ইতিহাস আর কল্পনার মিশেলে লিখেছেন এই উপন্যাস। যেখানে কিছু চরিত্র, স্থান, সময়ের বাস্তবতা ছিল। আর এগুলোর সাথে আরও কিছু কাল্পনিক চরিত্র আর ঘটনার সমন্বয়ে পাঠককে নিয়ে গেছেন মধ্যযুগের যশোহরে।
তখন জলদস্যুরা গ্রামে গ্রামে হানা দিয়ে নারী পুরুষ শিশু নির্বিশেষে ধরে দাস হিসাবে বিক্রি করা তখন ছিল এসব জলদস্যুদের উপার্জনের অন্যতম পথ। কিন্তু প্রতাপাদিত্য রাজা হবার পর এই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শক্তিশালী নৌবহর দিয়ে জলদস্যুদের যশোহর নৌ সীমান্তে প্রবেশ বাঁধা প্রদান করেন। জলবস্যুদের নৌবহর জ্বালিয়ে দেন, জলদস্যুদের হত্যা করে্ন।
আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে যায় জলদস্যুদের সর্দার দাভি ডি’ ত্রুজ। পরিকল্পনা করে প্রতাপাদিত্যকে উচিৎ শিক্ষা দিতে আর হারানো বানিজ্য ফিরে পেতে অপহরণ করে রাজার বোনপো মিহির এবং প্রতিবেশি ভূঁইয়ার একমাত্র সন্তান সত্রাজিতকে। মহারাজা তাঁর রাজশক্তি প্রয়োগ করেও ওদের উদ্ধারে ব্যর্থ হন। কারণ প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সর্ষের ভেতর আস্তানা গেড়েছে ভূত। ওদিকে মানসিংহ এগিয়ে আসছেন উত্তর ভারত থেকে মোগল বশ্যতা স্বীকার না করার জন্য প্রতাপাদিত্যকে একটা শিক্ষা দিতে।
এমতাবস্থায় চাপের পারদ যখন তুঙ্গে তখন সবাইকে একরকম বাধ্য হয়েই শরণাপন্ন হতে হয় প্রতাপাদিত্যের নিজ রাজ কারাগারে বন্দী উষ্ণীষ রায়ের। এই উপন্যাসের সবথেকে প্রভাবশালী চরিত্র। উষ্ণীষকে দিয়েই এই উপন্যাস শুরু হয় আর ওকে দিয়েই হয় শেষ। রহস্যময় এই চরিত্রটি গোটা লেখার টানটান উত্তেজনা ধরে রাখার মূল উপাদান। তাকেই দায়িত্ব দেয়া হয় এই সংকটকালে মিহির আর সত্রাজিতকে মুক্ত করে নিয়ে আসার। কারণ এই কাজে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে।
আমি নিজেও খুলনা তথা বৃহত্তর যশোহর অঞ্চলের বাসিন্দা। তাই এই উপন্যাসটি আমার জন্য বাড়তি আনন্দ সৃষ্টি করেছে। কিশোর বান্ধব লেখাটিতে ইতিহাস, ষড়যন্ত্র, রোমাঞ্চ, উত্তেজনা, লড়াই প্রায় সবই আছে। তবে ইতিহাস জানতে এই উপন্যাস নয়, বরং ইতিহাসের ব্যাপারে আগ্রহী হতেই এমন লেখাগুলি গুরুত্বপূর্ণ।
খুব সামান্য জ্ঞান নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনাটি লিখলাম। যদি তথ্যগত কোন ত্রুটি থেকে থাকে। মার্জনা করবেন।
আড়ালে রয়েছে সে
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী ১৪২৯
Leave a comment