“আর্সেন লুঁপা”
আর্সেন লুপাঁ হলো এমন একজন ভদ্র চোর যিনি তার নিজের থেকেও খারাপ লোকদের কাছ থেকে চুরি করে থাকেন। হাত সাফাই এর সাথে ছদ্মবেশেও বেশ পারদর্শী। পুলিশ বা ডিটেক্টিভ দের থেকে সবসময় একধাপ এগিয়ে থাকে সে। যাকে শুধু আধুনিক নয় বরং বলা যায় আগামীকালের মানুষ। সংস্কৃত, মার্জিত একজন ফরাসী রুচির নিখুঁত ব্যক্তি হলো এই “লুপাঁ।”
আর্সেন লুপাঁকে তো কেউ কেউ “ফরাসি শার্লক হোমস” হিসেবেও বিবেচনা করে!
🖌️এক নজরে –
আর্সেন লুপাঁ, জেন্টলম্যান বার্গলার
লেখকঃ মরিস লেবলাঁ
অনুবাদঃ অসীম পিয়াস, লুৎফুল কায়সার, ডিউক জন, খালেদ নকীব, মহিউল ইসলাম মিঠু, জাবেদ রাসিন, নজরুল ইসলাম, কুদরতে জাহান,নিঝুম
সম্পাদনাঃ মহিউল ইসলাম মিঠু
প্রচ্ছদঃ সজল চৌধুরী
জনরাঃ ক্রাইম ফিকশন, থ্রিলার, মিস্ট্রি
মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৫০ টাকা
প্রকাশকালঃ আগষ্ট – ২০২২
🖌️ফ্ল্যাপ থেকে –
আর্সেন লুপাঁ। তাঁকে বলা হয় “জেন্টলম্যান বার্গলার” অর্থাৎ “ভদ্রবেশী চোর।” কিন্তু তিনি কি আসলেই চোর, না-কি চোরের ওপর বাটপারি করা বাটপার, নাকি ধুরন্ধর কোনো গোয়েন্দা সেটা পাঠকরা নিজেরাই আবিষ্কার করুন বইয়ের পাতায়। হাত সাফাইয়ের পাশাপাশি ছদ্মবেশ নিতে ভীষণ পটু এই ভদ্রবেশী চোর; পুলিশ আর গোয়েন্দাদের থেকে তো সবসময় এক কদম এগিয়ে থাকেই, সময়ের থেকেও যেন এক কদম এগিয়ে। অন্তত তার কর্মকাণ্ডে তাই মনে হয়।
যে বিষয়টি অন্য সব অপরাধীদের থেকে আর্সেন লুপাকে আলাদা করে তুলেছে সেটা হলো তার নৈতিক অবস্থান। দুনিয়া জোড়া মানুষের মন কেড়ে নেওয়া আর্সেন লুপাঁকে কেউ কেউ “ফরাসি শার্লক হোমস” হিসেবে বিবেচনা করে। আবার কারো কারো চোখে তিনি শার্লক হোমসের চেয়েও নিখুঁত!
বইয়ের পাতায় পাঠক লুপাঁকে কখনও দেখবেন নিপুণতার সাথে চুরি করতে, কখনো দেখবেন রহস্যের সমাধান করতে, আবার কখনও দেখবেন খুনের তদন্ত করতে- এক বহুমুখী চরিত্রের অধিকারী তিনি। যা কিছুই করুক সবকিছুতেই একটা মিল পাওয়া যায়, সেই মিলটা হলো নিজের কাজকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তিনি। কেউ জানে না এই আর্সেন লুপাঁ দেখতে কেমন, তার পরিচয় শুধুই তার কাজ দিয়ে। কারণ তার কাজ দেখলেই সবাই জেনে ফেলে এটা আর্সেন লুপাঁর কাজ, চেহারার দরকার হয় না।
🖌️পাঠ অভিব্যক্তি –
যেহেতু এটা একটা গল্পগ্রন্থ, তার উপড় আবার প্রত্যেকটা গল্প লিখেছেন ভিন্ন ভিন্ন লেখক। তাই চাইলেও এক লাইনে কিছু বলা যাবে না। আর যদি বলতেই হয়, বলবো মিশ্র প্রতিক্রিয়া অনুভূত হয়েছে।
The Arrest of Arsène Lupin গল্পটা আমার অ্যাভারেজ লেগেছে। এরকম হাজারটা কাহিনি প্রচলিত আছে, যে কোনো চোরের জীবনে। ভালো লাগেনি।
Arsène Lupin In Prison গল্পটায় যত্নের ছাপ স্পষ্ট পেয়েছি । লেখনশৈলী খুব মনোরম আর সাবলিল। চিঠিগুলো একদিকে যেমন মজার, অন্যদিকে লুঁপার আত্মবিশ্বাস কতটা গভীর তা-ও অনুমান করা যায়। ভালো লাগলো গল্পটা পড়ে।
তবে আশ্চর্য হলেও সত্যি, সারপ্রাইজ হইনি। কারণটা বুঝতেই পারছেন… হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি আগেই বুঝে ফেলেছি পুরো সিনারিয়োটা।
সম্পাদক সাহেবের The Escape of Arsène Lupin গল্পটা ভালো লেগেছে। লুঁপার উপস্থিত জ্ঞান যে অনেক গভীর আবার প্রমান হলো গল্পটায়। বরাবরের মতো লুঁপার হালকা রসিকতাগুলো উপভোগ করেছি।
অ্যাভারেজ লেগেছে The Mysterious Traveller গল্পটা। তবে গল্পটা যে খারাপ ছিলো, এমন কিন্তু নয়। কেন জানিনা মনমতো হয়নি।
The Queen’s Necklace গল্পটিতে একটি পারফেক্ট চুরি কিভাবে করতে তার নিখাদ বয়ান। আর্সেন লুঁপা আসলে প্রডিজি! তবে সেটা চুরির ক্ষেত্রে!! ভালো লেগেছে।
The Seven of Hearts গল্পটি নিয়ে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। মানে তেমন ছাপ ফেলতে পারেনি আমার মনে।
Madame Imbert’s Safe গল্পটিতে আর্সেন লুপাঁর প্রথম হারের স্বাদ নেয়। দীর্ঘ ছয় মাসের পারফেক্ট নীলনকশা প্রণয়ন আর কঠোর পরিশ্রম। শেষে কি পেলো লুঁপা… লবডঙ্কা! অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করেছে গল্পটিতে।
The Black Pearl গল্পটায় একজন চোর ও একজন গোয়েন্দা কম্বিনেশন বর্ণিত হয়েছে প্রাঞ্জল ভাষায়। সেই সাথে লুপাঁর যে ঠান্ডা মস্তিষ্কের চোর মহাশয় সেটা ক্লিয়ার ফুটে উঠেছে। ভাল্লাগছে।
লুঁপা ভার্সাস শার্লক হোমশ। Sherlock Holmes Arrives Too Late পড়ার জন্য উদগ্রীব ছিলাম। গল্পে একদিকে পৃথিবীর সেরা গোয়েন্দা আর অন্যদিকে সেরা চোর। গল্পটায় লুঁপার একদিকে প্রকাশ পেয়েছে শার্লক ভীতি অন্যদিকে শার্লককে নিয়ে খেলার মানসিকতা। আর আমি পেয়েছি আত্মতৃপ্তি।
🖌️প্রধান চরিত্র –
পুরো বইটির বিভিন্ন গল্পে অনেক চরিত্র আসলেও উল্লেখযোগ্য লুঁপা বাদে একজনই ছিলো। তিনি হলেন ফরাসি গোয়েন্দা গাঁইমার্দ।
প্রত্যেকটা গল্পে তার সরব উপস্থিতি লক্ষ্য কর গেছে। এবং ভদ্রলোককে কখনও হাল ছাড়তে দেখা যায়নি। প্রত্যেকবার নতুন কর্মশক্তিতে বেরিয়ে গেছেন লুঁপাকে ধরার জন্য।
তিনি-ই লুঁপার একমাত্র বিপরীত প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি-ই লুঁপাকে গ্রেফতার করেন এবং আইনের আওতায় নিয়ে আসেন।
কিন্তু বিধিবাম…
লুঁপা-কি জেলে বন্ধি থাকার মানুষ? মোটেও না। এবং সবাই এটাও বিশ্বাস করে সে চাইলেই পালাতে পারবে। এমন কোনো জেল তৈরি হয়নি তাকে বন্ধি করে রাখার জন্য। অতঃপর সে পালায়। সবার চোখের সামনে দিয়ে।
এছাড়াও ফরাসি গোয়েন্দা মশিয়ে দুঁদে কে দেখা গেছে অনেকগুলো গল্পে। তবে কোনো গল্পে, বিশেষ কোনো ছাপ ফেলতে আমার চোখে পড়েনি।
নেলি আন্ডারডাউন। লুঁপার লাভ ইন্টারেষ্ট। তবে কোনো পরিণতি পায়নি গল্পগ্রন্থে। এক তরফা ভালোবাসা বলা যায়। কিন্তু সে-যে সামনে আরও আসবে এটা বেশ বুঝতে পারছি।
🖌️অরিজিন অভ লুপাঁ –
জনপ্রিয় লেখক “Pierre Alexis Ponson du Terrail” সৃষ্টি করেন তাঁর বিখ্যাত চরিত্র “Rocambole.” লেখক তাঁর কাজগুলো ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত করেন 1857-1870 সালের মধ্যবর্তী সময়কাল পর্যন্ত।
আরেকজন বিখ্যাত ইংলিশ লেখক “E.W. Hornung” সৃষ্টি করেন আরেকটি বিখ্যাত ভদ্রবেশী চোর “A.J. Raffles”-কে। তিনি তা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করেন 1898-1909 সময়কালের মধ্যবর্তী সময়ে।
লেখকদ্বয়ের সৃষ্ট Rocambole ও A.J.Raffles চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ফরাসি লেখক “মরিস লেবলাঁ” সৃষ্টি করেন তাঁর বিখ্যাত চরিত্র “আর্সেন লুঁপা।”
তবে মজার ব্যাপার হলো, অনুপ্রাণিত চরিত্র লুঁপা ও র্যাফেলস-কে আবার অনুকরণ করে লেখক “Luis Joseph Vance” সৃষ্টি করেন তাঁর প্রিয় চরিত্র “Lone Wolf” নামের রত্ন চোরকে।
পুরো ব্যাপারটা হলো, একটা চরিত্রের ছায়াকে নিয়ে সৃষ্টি হলো আরেকটি প্রতিচ্ছায়া। আবার সেই প্রতিচ্ছায়ার ছায়াকে নিয়ে সৃষ্টি হলো প্রতিচ্ছায়ার-ও প্রতিচ্ছায়া!!
🖌️লেখকের লুঁপা –
ফরাসি লেখক “Maurice Leblanc” তাঁর সৃষ্ট চরিত্রটি “আর্সেন লুঁপা”-কে “Je sais tout” ম্যাগাজিনে ধারাবাহিক ছোটগল্পের একটি সিরিজ আকারে পরিচিত করেন। সময়কালটা ছিলো ১৯০৫ সালের ১৫-ই জুলাই। প্রথম গল্পটা ছিলো “The Arrest of Arsen Lupin.”
পরবর্তীতে “মরিস লেবলাঁ” লুঁপাকে নিয়ে মোট ১৭টি উপন্যাস ও ৩৯টি ছোটগল্প লেখেন।
🖌️অনুবাদ –
একঝাঁক অনুবাদকের অনেক যত্নের তুলিতে আঁকা গল্পগ্রন্থটি আসলেই অনেক সুন্দর। প্রাঞ্জল ও সাবলিল অনুবাদ।
প্রত্যেকটা গল্প আলাদা অনুবাদকের হলেও সম্পাদনার গুণে একটা কানেক্ট স্টোরিলাইন তৈরি করেছে। সেইসাথে প্রত্যেক অনুবাদকও তাদের সিগনেচার মার্ক প্রত্যেকটা গল্পে রেখেছেন সযতনে।
🖌️প্রচ্ছদ –
এক কথায় বলতে গেলে “জোশ!” একদম ক্লাসিক একটা লুক এসেছে। দেখলেই এর ভিতর হারিয়ে যেতে মন চাইবে। তবে আরও একটু কালার গ্রেডিং হলে বোধহয় মন্দ হতো না। আরও আভিজাত্য ও গাম্ভীর্য লুক আসতো।
🖌️প্রডাকশন –
বেনজিননের সাথে এটাই আমার প্রথম পথচলা। তা-ও আবার সিগনেচার প্রজেক্ট। তাই সবমিলিয়ে প্রত্যাশাটাও ছিলো অনেক বেশি। যাকে বলে একদম “হাই-লেভেলের।”
তবে হতাশ হইনি একটুও। বরং সারপ্রাইজ হয়েছি। এতো সুন্দর প্রডাকশন আশা করিনি। তাই চাওয়ার থেকে পাওয়াটা অনেক বেশি হয়েছে। এতো সুন্দর কভার পেজ। ধন্যবাদ বেনজিন।
🖌️শব্দ বিভ্রাট –
মানুষ মাত্রই ভুল। বেনজিনও তার উর্ধে না। সেজন্যই মনে হয় অনেকগুলো ভুল পেয়েছি। সব ভুল যে প্রিন্টিং মিস্টেক ছিলো এমন না। কিছু প্রুফ রিডারের ভুল ছিলো। এখানে নেগেটিভ মার্কিং আসবে আমার। কারণ কিছু ভুল ছিলো এমন যে বাক্যের অর্থ পর্যন্ত বদলিয়ে ফেলেছে।
সুক্ষ্ম কিছু ভুল পেয়েছি, যেগুলো সম্পাদনার টেবিল থেকে এসেছে। কিছু বানান আপাত দৃষ্টিতে শুদ্ধ মনে হলেও, ব্যাকরণগত দিকে সেগুলো ভুল। প্রিন্টের পূর্বে আরও একবার চোখ বোলানো উচিৎ ছিলো বলে আমি মনে করি।
সবমিলিয়ে আমার চোখে ২৫+ ভুল ধরা পড়েছে। হবে আমার বিশ্বাস দ্বিতীয়বার পড়লে সেটা আরও বাড়বে। কারণ প্রথমবার গল্পে মনযোগ বেশি থাকে, বানানে না। আশা করছি পরবর্তী মুদ্রণে এসব আর থাকবে না।
🖌️শার্লক হোমস বনাম আর্সেন লুপাঁ
লেখক মরিস লেবলাঁ লুঁপা সিরিজে হোমসকে সর্বমোট তিনবার মোলাকাত ঘটান। এর মধ্য প্রথমবার ১৯০৬ সালের “শার্লক হোমস এরাইভ টু লেইট।”
শার্লকের প্রথম সাক্ষাৎকারের গল্পটা এখানে শুধু নেয়া হয়েছে। পরবর্তী কোনো বইয়ে বাকী দুটো সাক্ষাৎটাও আসবে।
শার্লকের স্রষ্টা “স্যার আর্থার কোনান ডয়েল” লুঁপার সাথে শার্লককে এক-ই টাইমলাইনে নিয়ে আসাটা একদম মেনে নেননি। কপিরাইট মোকদ্দমা করার পর “মরিস লেবলাঁ” নাম বদলাতে বাধ্য হন।
শার্লক হোমস হয়ে যায় “হার্লক শোমস” আর ওয়াটসন হয়ে যায় “উইলসন।”
🖌️কিছু খুচরো আলাপ –
তিন গোয়েন্দা সিরিজে অন্যতম একটি চরিত্র ছিলো “জুয়েল থিফ শোঁপা।” আমি কেন জানিনা লুঁপার সাথে শোঁপার একটা মিল খোঁজে পাচ্ছি। হতে পারে মেলায় হারিয় যাওয়া দুই ভাই!! (-_-)
বেনজিনের আরও বই আমার সংগ্রহের ফাঁকফোকরে থাকতে পারে। তবে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
একটা অভিযোগপত্র লিখতেছি লুপাঁর কাছে, বেনজিনের বিরুদ্ধে। কারণ বেনজিন আমায় ঠগিয়েছে। একটা ক্যারেক্টার পোস্টার দিয়েছে, তবে তা ধুলোমাটি লাগানো। কোন “পঁচা ডিম” যেন পা-মাড়িয়ে দিয়েছে। আর আরেক “পাজির পাঝাড়া” সুন্দর করে প্যাকেট-বন্ধি করে দিয়েছে। এর উপযুক্ত বিচার না করলে সম্পাদক সাহেবের নামটা প্রথমে বসিয়ে চিঠিটা ডিরেক্ট পোস্ট করে দিবো।
🖌️পরিশিষ্ট –
একটা আত্মতৃপ্তি পাচ্ছি, যে আত্মতৃপ্তিটা বন্ধুর টাকায় বিরিয়ানি খাওয়ার পর পাওয়া যায়। এ বইটা ঠিক এমন-ই।
তো যা বলছিলাম, সব মিলিয়ে একটা গল্পগ্রন্থ ঠিক যেমন হওয়ার কথা, এটা তার থেকে ব্যতিক্রম নয়। কিছু ভালো গল্পের সাথে কিছু মন মতো না হওয়া গল্পও সামিল রয়েছে। কিছু সুন্দর শব্দ ভান্ডারের ফাঁক-ফোঁকরে কমন কিছু মিসটেক। সম্পূর্ণ ভালো লাগাটার সাথে এক-আধটু মন্দ লাগা। তবে একটা সিরিজের প্রারম্ভ হিসাবে শুরুটা চমৎকার। সিরিজের পরবর্তী বইগুলোর জন্য শুভ কামনা।
হ্যাপি
Leave a comment