চোখ আর হাত কতো যে তফাৎ!
পর্যবেক্ষণ, ভাবনা ও বিশ্লেষণগত কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য প্রতীয়মান হয় দুই বা ততোধিক লেখকের মধ্যে। এই আপ্তবাক্যের এতোটা অকাট্য প্রমাণ পেতাম না। পেয়ে সমৃদ্ধ আমি। একাধিক মাধ্যম থেকে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা পড়বার ব্যাপারে বড়োসড় আপত্তির মুখে পড়েও কিনে ফেলেছিলাম ‘আমি রবি ঠাকুরের বউ’। অন্যান্য কাজ এবং এক ধরণের আলস্য যোগ এক ধরণের দ্বিধায় তুলে রেখে দিয়েছিলাম মলাটছেঁড়া বইটা। পড়া শেষে গালে ডানহাত আর মাথায় বাঁহাত ঘষতে ঘষতে ভাবা শেষ করে এখন লিখছি। হরিশংকর জলদাস আর রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গিগত তুলনা এ লেখার বিষয়।
হরিশংকর জলদাস প্রান্তজনকে ফিকশনের বিষয় করে লেখেন। তাঁর ‘প্রান্তজনের গল্প’ শিরোনামের গল্প সংকলনের ফ্ল্যাপে নারীর প্রান্তজনসত্তার প্রসঙ্গ রয়েছে। খুব অল্পের মধ্যে সেখানে যে অনেক কথা তিনি বলেছেন, তার সরল প্রতিপাদন বোধকরি তাঁর উপন্যাস ‘আমি মৃণালিনী নই’। মৃণালিনী সেখানে প্রান্তজন। পুরুষশাসিত পরিবারতন্ত্রে একজন নারী বিয়ের পরই সাধারণত তার নাম হারিয়ে বসে। হয়ে যায় ‘মিসেস অমুক’। এই বিষয়টির সমালোচনা ঘোরালোভাবেই করা হয়েছে ‘আমি মৃণালিনী নই’ উপন্যাসে।
এদিকে ‘আমি রবি ঠাকুরের বউ’ পরতে পরতে রবি ঠাকুরের তথা পুরুষের দাসত্ব স্বীকার করে নেওয়া এক নারীর কাহন। মারাঠি আন্না তড়খড়কে যেখানে নলিনী বলে ডাকতেন রবীন্দ্রনাথ, সেই পদ্মফুলের উপমা তাঁর বিবাহিতা স্ত্রীকে তিনি নিজে দেননি— রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমন ভাবনা। পারিবারিক চাপ ভবতারিণীর নতুন নামকরণের প্রভাবক।
‘আমি মৃণালিনী নই’ অবশ্য ভিন্ন কথা বলছে। মৃণালিনী নামের আত্মপ্রকাশ বাসরঘরেই রবির মাধ্যমে— বলতে চেয়েছেন হরিশংকর জলদাস। নন্দনকাননের যে নীলপদ্মের প্রসঙ্গ, সেটিকে মেলালে ভাবা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথের কাছে নারী মানে পদ্মফুলের উপমা। এদিকে চৈনিক হ্যান এবং মিং রাজত্বকালে পদ্মফুলকে নারীযোনির প্রতীক ধরা হতো। চৈনিক তাওবাদী কবিতা এবং ‘Art of Bedchamber’-এর মতো তাওশাস্ত্রে ‘golden lotus’ শব্দবন্ধের উল্লেখ যোনিকে নির্দেশ করে। সেসব অবশ্য অনেকটাই দূরবর্তী প্রসঙ্গ।
দুটো লেখায়ই বিয়েপরবর্তীকালে নারীর নাম পরিবর্তনের সমালোচনা লক্ষণীয়।
‘নষ্টনীড়’ উপন্যাসের প্রসঙ্গটি জরুরি।
এক্ষেত্রে বলেন্দ্রনাথের সাথে মৃণালিনী দেবীর বন্ধুত্বের ব্যাপারটি যুক্ত করে ভেবেছেন হরিশংকর জলদাস। মৃণালিনী দেবীর ব্যক্তিগত ভাবনার জায়গাটি তুলে ধরেছেন জোর দিয়ে সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যার বা বিবৃতির নামগন্ধ নেই।
প্রসঙ্গত হরিশংকর জলদাস তাঁর ‘হৃদয়নদী’ উপন্যাসে যেমন ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের হোসেন মিয়া চরিত্রের একটা মূল্যায়ন লিখেছিলেন, তেমনই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিজীবনের কিছু কথাও লিখেছিলেন। একইভাবে ‘সেই আমি নই আমি’ উপন্যাসেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে মন্তব্য করিয়েছেন শকুনিকে দিয়ে। বলতে চাচ্ছি এ জাতীয় মূল্যায়ন আসলে এক সাহিত্যিকের কাছে অপর সাহিত্যিকের ওপর অর্পিত শ্রদ্ধার্ঘ্য। হরিশংকর জলদাসের লেখায় এমন শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের উদাহরণ কম নেই।
এদিকে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আমি রবি ঠাকুরের বউ’ বলছে মৃণালিনীকে জানিয়েই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘নষ্টনীড়’। ‘নষ্টনীড়’-এর ব্যাখ্যার জায়গাটিও হরিশংকর জলদাসের সাথে মিলতে চায় না রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
যদিও ঠাকুরবাড়ির গৃহস্থালির ব্যাপার কিছু সূক্ষ্মভাবেই বোধকরি বেশি করে এসেছে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায়, হরিশংকর জলদাসের লেখার তুলনায়। তবু, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ঠাকুরবাড়ির অনেকখানি ঘরোয়া পরিবেশ নিয়ে লিখেছেন এ লেখাটা— শুধু যদি একথা বলি, তাহলে তাঁর বিশ্লেষণী পাঠকমননকে অবহেলাই করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের ব্যাখ্যায় রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় একজন পাঠক হিসেবে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়ে রেখেছেন।
© রেজওয়ান আহমেদ