“আমি বৃক্ষের কাছে যাই, তাকে স্পর্শ করি। এক নীরব, অটল, স্থির অথচ জীবন্ত এক সত্তা। ভাবতেই অবাক লাগে বৃক্ষও আমার উপস্থিতি টের পাচ্ছে।”
সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ এর “অলীক মানুষ” এর খুব পছন্দের একটা উক্তি আমার কাছে। যতটুকু বুঝেছি ততটুকুই নিজে সাজিয়ে লিখেছি। এ আমার উপলব্ধি, হুবুহু বইয়ের পাতার লাইন নয়।
কোলাজ চিনেন? ধরুন একটি ছবি ভেংগে টুকরোটুকরো করা হলো, এরপর আবার সেই ভাঙা টুকরোগুলো সাজিয়ে ছবিটা পুনরদ্ধার করতে বলা হলো। ছবি পুনরদ্ধার হবে ঠিকই, কিন্তু এবার খুব কাছ থেকে ছবিটা দেখলে বুঝতে পারবেন না। একটু দূরে সরে তারপর বোঝা যাবে। অন্যভাবে ছবিটা আবিষ্কার করতে পারবেন, হয়তোবা অন্য এক রূপে। আসলে হৃদয়ংগম না করলে ছবির অন্য রূপ টা হয়তো আপনার কাছে ধরাই দেবে না। কি এক অদ্ভুত জিনিস তাই না? “অলীক মানুষ” ঠিক এমনই একটা বই মনে হয়েছে। অসংখ্য ছোট কাহিনী, পড়লে মনে হবে- “আরে কেমন লেখক বলুন তো মশাই? এক কাহিনী শেষ না করেই আরেক জাগায় লাফ মারে!” কিন্তু আস্তে আস্তে শেষ অব্দি পড়লে বোঝা যায়- “না শেষ হয় নি,এইতো একটু আগেই কি যেন পড়ছিলাম? হ্যা, হ্যা মনে পড়েছে, এতো সেই কাহিনীর পরেই।” এরকম একটার সাথে আরেকটার যোগসূত্রের মিশেল ঘটিয়েই বইটার সুখপাঠ্যের কোলাজ উদ্ধার সম্ভব হয়। কি বিষ্ময়!
ইংরেজিতে একটা কথা আছে – “All my Geese are Swans”. অর্থাৎ ” আমার সকল কানা ছেলেই পদ্মলোচন”। সন্তান যতই বিরুদ্ধে যাক, যতই নিজ সন্তানের উপর আশাকৃত অনুশাসন না মানুক পিতামাতা চান, “হে পরমেশ্বর, আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।” উপন্যাসটিতে সেই সন্তান শফি আর তার কথিত “পীর হইতে না চাইয়াও হয়ে গেলাম পীর” এমন পিতা বদির। জীবন সায়াহ্নে এসে এক সন্তান যিনি স্বয়ং পিতাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন, পিতার সাথে তার একপলক দেখা করার প্রবল আকুতি নিশ্চিত চোখে পানি এনে দেবে, নয়তো আপনি নিজেই কিছুক্ষণের জন্য বিষণ্ণ হয়ে যাবেন। এভাবেও সম্ভব?
সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তী সময়টাকে উপলক্ষ্য করে লেখা এ উপন্যাস। আমি বইটিতে যে বিষয়গুলো লক্ষ্য করেছি-
১.তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচার এবং নিষ্পেষণ।
২. ব্রহ্মচারী ধর্ম সম্পর্কে বেশ ভালোভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে রাজা রামমোহন রায় এবং পবিত্র কুরআন শরীফের সর্বপ্রথম বাংলা অনুবাদকারী ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ব্রহ্মচারী ছিলেন।
৩. সমাজের কিছু অতিপ্রাকৃত কুসংস্কার।
৪. ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে যাওয়া কিছু মানুষের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে এ উপমহাদেশের স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার তীব্র আকাংখা।
৫. যুগের পর যুগ ধরে নারীদের উপর যথেচ্ছভাবে চালিয়ে দেয়া এ সমাজের কিছু ট্যাবু এবং একপেশে সিদ্ধান্ত। যা বই পড়তে পড়তে কখনো কখনো মন খারাপ, কখনো বা ভীষণ রাগের উদ্রেক হয়ে দাড়াবে।
৬. সতীদাহ প্রথা ভয়াবহ অনাচার ছিলো।
৭. ধর্মীয় অন্ধভক্তি অভিশপ্ত জিনিস।
৮. তখনকার সমাজের অন্ধ বিশ্বাস এর বিরুদ্ধে রাজা রামমোহন রায়, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ যে সংগ্রাম করেছেন তার ঈষৎ অংশ তুলে ধরা হয়েছে।
৯. আমরা সবাই প্রকৃতির সন্তান। যাই কিছু হোক, প্রকৃতির সাথে জীবের সংযোগ থাকা প্রয়োজন কেন, এর গুরুত্বে লেখক ফিলোসোফিক্যালি খুব ভালোভাবে বর্ণনা দিয়েছেন। (একটু ডিপলি ভাবার সাথে ইমাজিনেশনটা চাই কিন্তু!)।
দারুন এ বইটি বাগিয়ে নিয়েছে বেশখানিক খ্যাতনামা পুরষ্কার। পাবেই বা না কেন?উল্লেখ্য-
১.ভুয়ালকা পুরষ্কার- ১৯৯০।
২.আকাদেমী পুরষ্কার-১৯৯৪।
৩.বঙ্কিম পুরষ্কার-১৯৯৪।
৪.সুরমা চৌধুরী মেমোরিয়াল আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরষ্কার-২০০৮।
ধর্ম, জাত, সমাজ সকল কিছুর উর্ধ্বে গিয়ে একজন মানুষ হিসেবে বইটি পড়ুন। লেখকের অনুভূতি বুঝতে কষ্ট হবে না।
বইটি পড়েছি প্রায় মাসখানেক আগে। বইটির শেষপাতা পড়ার পর যেই রেশ রয়ে গিয়েছে তারই তাগিদের সূত্রে লিখতে বসা আসলে। মনে হলো সবাইকে জানাই, “এমন একটি বই আছে, পড়তে পারেন কিন্তু।” অনেকে হয়তো আগ থেকেই পড়ে বসে আছেন, হাহাহা(এটার সম্ভাবনাই বেশি)। সে ক্ষেত্রে আমার মতো এ নাদান বান্দার এত বড় একজন লেখকের বইয়ের রিভিউ লেখার বিষয়টা ক্ষমাসূচক দৃষ্টিতে দেখবেন।
বই- অলীক মানুষ
লেখক- সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ।
(ভালো ছবি তুলতে পারি না, এজন্য অন্যত্র হতেই মেরে দিলাম)।
Leave a comment