আসসালামু আলাইকুম।
সুন্দর একটা বই পড়ে শেষ করলাম। ভাবলাম সবার সাথে শেয়ার করি।
বই: অনাবাসী
লেখক: মোঃ রেজাউল করিম
প্রকাশনী: গতিধারা
প্রচ্ছদ: সিকদার আবুল বাশার
পৃষ্ঠা : ১৩৪
মুদ্রিত মূল্য: ২০০ টাকা
প্রকাশকাল : বইমেলা ২০১৯
কাহিনীর শুরু ১৯৭৮ সালে। সেবার প্রথম রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
“কারা যেন দরজায় লাথি দিচ্ছে- কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজাটি ভেঙে পড়ল। ভয়ে হালিম পায়খানার মধ্যে হেরিকেনটা নিভিয়ে ফেলল। ক্ষণপরেই সে তার বাবার চিৎকার শুনতে পেল। তাকে বোধহয় পেটাচ্ছে। কারা যেন গুলি করছে। বাড়ির মধ্যেই কি? ছোট্ট হালিম কিছু বুঝে উঠতে পারল না। বাবার আর্তচিৎকার শুনতে পেল। মায়ের কান্না কানে এল। আরও ঘণ্টাখানেক পায়খানাতে বসেই মায়ের গোঙানি শুনতে পেল। ভয়ে হালিমের বাক্শক্তি লোপ পেয়েছে। সে বোধ হয় চেতনাও হারিয়েছিল, নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিল- মনে নেই।”
গল্পের শুরুতে হালিমের মর্মান্তিক পরিণতির দৃশ্য ফুটে উঠে।
গল্পের মূল চরিত্রগুলো হলো হাশিম আলী এবং তার পরিবার, আবদেল করিম , তার স্ত্রী, দুই ছেলে মেয়ে শাফায়েত এবং রোকসানা। সাথে ছিলো মায়ানমারের অত্যাচারে বাবা-মা হারা ছয় -সাত বছরের হালিম।
এই কয়টা চরিত্রের মাধ্যমে পুরো অসহায় রোহিঙ্গাদের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসে।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার এই উপন্যাসে অসাম্প্রদায়িক কিছু চরিত্র উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো বিরাজমান। তার মধ্যে অন্যতম হলো উথান চরিত্র টি।
অরাজকতার রাত শেষ হওয়ার পর
স্ত্রী সন্তান আর অসহায় হালিমকে নিয়ে দিগবিদিক ঘুরছিলো হাশিম। পূর্বপরিচিত বৌদ্ধধর্মশালার প্রধান তিন থেন এর কাছে দিনটার জন্য আশ্রয়ে যায় হাশিম।
“সব শুনে তিনি বললেন, ‘আমি সরকারের বিরোধী কোনো কাজ করতে পারব না। তুমি কোথায় যাবে তা তুমিই ঠিক করো। তুমি এখনি চলে যাও।’ তিন থেন আবারও পবিত্র গ্রন্থ পড়তে শুরু করলেন, বুদ্ধের বাণী- ‘ভালো কাজ সবসময় কর। বারবার কর। সবসময় ভালো কাজে নিমগ্ন রাখ। সদাচরণই স্বর্গসুখের পথ।”
হাশিম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ধর্মশালা থেকে বের হয়ে এল।
এখানে বুদ্ধের বাণী তিন থেন শুধু বাণী হিসেবেই আওড়াচ্ছিলেন। বাস্তবে প্রয়োগ করার মতো সৎ সাহস তার ছিলো না। সেই সাহস দেখিয়েছিলেন উথান।
উথান তার সজাতির বিরুদ্ধে গিয়ে মানবতাকে প্রাধান্য দিয়ে রোহিঙ্গা পাঁচজন মানুষকে নিজ ঘরে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
ঘটনাক্রমে হাশিম তার পূর্বপরিচিত আবদেল করিমকে খুঁজে পায়। আবদেল করিমের পরিবারও তখন থেকে এই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র হয়ে ওঠে। আবদেল করিম মংডু শহরের প্রভাবশালী মুসলিম। তবুও শহর ছেড়ে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে যেতে ভয় পায়। মৃত্যু ভয়ের পাশাপাশি নিজ কন্যার সম্ভ্রম হারানোর ভয়।
বাংলাদেশে যাত্রার কাহিনী ছিলো খুবই মর্মন্তুদ, যা পড়লে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাক সেনাবাহিনীর অত্যাচারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এক রোহিঙ্গা তরুণীকে ধর্ষণ করা হচ্ছে একটি বাড়ির অভ্যন্তরে। বাড়ির বাইরে রাখাইন সন্ত্রাসীরা হট্টগোল করছে কে আগে যাবে এই নিয়ে। নাফ ঘাটে এক তরুণীর দেখা মেলে- মৃতপ্রায়। মেয়েটিকে ধর্ষণের পরে বক্ষদেশ বেয়নেট দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হয়েছে। তবুও সে বেঁচে আছে। তার পিতা-মাতাও তাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে।
আবদেল করিম এসব দেখে নিজ কন্যার জন্য ভীত হয়। অর্থ অনর্থের মূল হলেও এই যাত্রায় বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে দুইটা পরিবার বাংলাদেশে পৌঁছে যায়।
বেশ কয়েক মাস পরে বর্মী সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়। কিন্তু তারা দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বনে যায়। আবদেল করিমের ছেলেমেয়েকে স্কুলে ভর্তি নেয়া হলো না। তিনি মেয়েকে বাড়িতে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করলেন। শিক্ষক বৌদ্ধ থুরামন। মাসের পর মাস, বছর- এবাবেই তরুণী রুকসানা ও থুরামনের মধ্যে মন দেয়ানেয়া চলতে থাকে।
উপন্যাসে থুরামন নামক আরেকটি অসাম্প্রদায়িক চরিত্র পাওয়া যায়। সাথে রোকসানা ও থুরামনের প্রেম,পালিয়ে বিয়ে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি সৃষ্টি করবে পাঠক মনে।
দেশে একটার পর একটা পরিবর্তন হতে থাকে। বার্মার বড়ো শহরের নাম পরিবর্তন করা হয়। দেশেরও নাম পরিবর্তন হয়। আরাকান হয়, রাখাইন। বার্মা হয় মায়ানমার। অবশেষে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। অথচ তারা সে দেশে বসবাস করছে ৮০০ বছরেরও বেশী সময়।
১৯৯১ সালে আবার শুরু হয় রোহিঙ্গা নির্যাতন ও দেশ থেকে ঠেলে বাংলাদেশের দিকে পাঠিয়ে দেয়া শুরু হয়। কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে বর্মীবাহিনী হত্যা করে। আবদেল করিমের ছেলে নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়ে কোনো রকমে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। আবদেল করিম যিনি কি’না উপন্যাসের একটা বিশাল অংশ জুড়ে বেচে থাকার লড়াইয়ে ছিলেন আরাকান পর্বতমালার মতোই অবিচল।
সেই আবদেল করিমকে স্ত্রী সহ হত্যা করা হয় নিষ্ঠুরভাবে। উপন্যাসের এমন কিছু অংশ রয়েছে যেখানে চোখের পানি রোধ করা মুশকিল হয়ে পরে।
হালিম ততদিনে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠনে যোগ দিয়েছে। তার সহায়তায় হালিমের চাচা ও হাশিমের পরিবার আবারও বাংলাদেশে আসে। এই পর্ব ছিল উত্তেজনায় ঠাসা। লেখক পর্বটিকে সাজিয়েছেন রোমাঞ্চকর এক অভিযাত্রা হিসেবে।
থুরামন ২০১৬ সালে তার পৈত্রিক জমি বিক্রির জন্য রাখাইনে যায়। সে সময়ে সেখানে রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যায়। থুরামন নিষ্পাপ হয়েও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বলির পাঠা হয়।
বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই হাশিম পরিবারের জীবন কাটতে থাকে। অন্য ক্যাম্পে ছিল আবদেল করিমের ছেলে বারেক।
হাশিমের দুই যুবক ছেলে বেঁচে থাকার সংগ্রামে হারিয়ে যায়। তাদের শোকে হাশিমের স্ত্রী মৃত্যুবরণ করে।
হালিমের প্রেম, বিয়ে, মর্মান্তিক পরিণতি অনাবাসী উপন্যাসের মর্মন্তুদ এক উপাখ্যান।
আবাসহীন এক জনগোষ্ঠীর জীবন গথা অনাবাসী উপন্যাস। উপন্যাসের গল্পের সাথে উপন্যাসের এই নামকরণ যথার্থ হয়েছে বলে আমার মনে হয়।
লেখক নিজেও অনেকদিন রোহিঙ্গাদের সাথে কর্মসুত্রে মিশেছেন। মিয়ানমারে গিয়েছেন দুইতিনবার। তারপর লিখেছেন “অনাবাসী”। তাই রোহিঙ্গাদের সংস্কৃতি, পোশাক,খাদ্যাভ্যাস সব নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। ক্ষনে ক্ষনে অভিভাবকহীন হয়ে পরা একটি জাতির অসহায়ত্বের কাহিনী ফুটে উঠেছে অনাবাসী উপন্যাসে যা পাঠককে রোহিঙ্গা শব্দের সাথে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিবেন। যেই শব্দটিকে আমরা বিভিন্ন সময় উপহাস করে বলি সেই শব্দ এবং শব্দের সাথে জড়িত মানুষগুলোর প্রতি এই উপন্যাস পড়ে জন্মাবে মায়া,ভালোবাসা।
উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্র নাই বলেই আপাতদৃষ্টে মনে হয়। যদিও আবদেল করিমের চরিত্র যেন এক অপার্থিব মানুষের চরিত্র বলে মনে হয়, তথাপি হালিমই যেন মুখ্য হয়ে উঠেছে। যদিও উপন্যাসের একেক অংশে একেক জন হয়ে উঠেছেন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।
Farhana Sumi
Leave a comment