“অতন্দ্র প্রহরী”
মনের মধ্যে অদ্ভুদ এক রোমাঞ্চ কাজ করছে।আমার স্বপ্নকে বাস্তবতার সাথে একাত্ন করতে পাড়ি দিতে হবে আর মাত্র দুবছরের পথ।বাংলাদেশ আর্মি একাডেমিতে দুবছরের ট্রেনিং শেষেই আমি সামরিক বাহিনীর সদস্য হওয়ার সম্মান লাভের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হব।এসব রঙিন স্বপ্নের ইন্দ্রজাল বুনছি এমন সময় ডাক পড়ল ট্রেনিং গ্রাউন্ডে যাওয়ার।
বুকে এক অপার উত্তেজনা নিয়ে হাজির হলাম ট্রেনিং গ্রাউন্ডে।অফিসাররা আমাদের একাডেমির নিয়মকানুন সম্পর্কে জানালেন এবং পরিচয় পর্ব সারলেন।
এর পরদিন সকালে শুরু হল আমাদের ট্রেনিং।প্রথম প্রথম ট্রেনিং ভালোই চলছিল।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সকলের সাথে তাল মেলাতে আমার বেশ সমস্যা হতে থাকে।ফলে আমি সকলের চেয়ে পিছিয়ে পড়ি।আগেই শুনেছি ট্রেনিংয়ে কষ্ট হবে কিন্তু এ-তো দেখছি একটু বেশিই।আমার অন্যমনস্কতা স্বভাবতই চোখ এড়াল না ট্রেইনারের।সাথে সাথে বলে বসলেন,”সবার জন্যে আর্মি প্রফেশান না।ডেডিকেশন না থাকলে ব্যাকআউট কর।তোমাদের দ্বারা দেশের সেবা হবে না।”
তার কথায় যেন আমার অবশিষ্ট প্রত্যয়টুকুও হারিয়ে গেল।বহু কষ্টে কোনো রকমে সেদিনের ট্রেনিং শেষ করলাম।
রাতে ট্রেনিং এর প্রথম দিনেই যা হল তা,আমাকে নিয়ে বাবার স্বপ্ন সবকিছু নিয়ে ভাবতে ভাবতে যেন সবকিছু বড্ড এলোমেলো ঢেকলো।তাই একটু শান্তির প্রশ্বাসের উদ্দেশ্যে হাঁটতে বেরোলাম।হাঁটতে হাঁটতে ট্রেনিং গ্রাউন্ডের দিকটায় আসতেই চোখে পড়ল কে যেন এক্সারসাইজ করছে।আমি বড়ই অবাক হলাম।এই রাতে কে এখানে এক্সারসাইজ করছে?তাই একটু এগোলাম লোকটাকে দেখতে।কাছে যেতেই দেখলাম,একজন অফিসার এক্সারসাইজ করছেন।
মনে মনে ভাবলাম থাক অফিসার মানুষ,ঘাটানোর দরকার নেই ! চুপচাপ চলে যাওয়াই বরং ভালো।
পেছন ফিরে চলে আসতে যে-ই পা বাড়ালাম অফিসারটি আমাকে লক্ষ্য করে বলল,”কি ইয়াং লেডি?এত রাতে ট্রেনিং গ্রাউন্ডে!”
আমি ভাবলাম,ধ্যাত!চোখে পড়ে গেলাম।এখন চোখে যখন পড়েছি উত্তর তো দিতেই হবে।
তাই আবার ফিরে তাকালাম।ফিরে তাকাতেই দেখি পঞ্চাশ এর কিছু উপরে বয়স্ক একজন অফিসার মুখে একচিলতে হাসি নিয়ে আমার দিকে কৌতুহলদ্দীপক চোখে তাকিয়ে রয়েছে।
আমি ইতস্তত করে উত্তর দিই,”স্যার,একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম।এখন ফিরে যাচ্ছি।গুড নাইট,স্যার!”
আবারও যেতে উদ্যত হতেই অফিসার বলে উঠলেন,”নিউ ব্যাচ না?এমনিতেই কেউ ট্রেনিং এর প্রথম দিন রাতে ঘুরতে বের হয় না।কোনো সমস্যা হচ্ছে?চাইলে বলতে পার।”
আমি প্রথমে ভীত হলেও ওনার চেহারায় বয়স এবং পদমর্যাদার ভারিক্কি ছাঁপিয়ে একধরনের প্রাণবন্ততা লক্ষ্য করি আমি।ফলে মুহুর্তেই তার কাছে অত্যন্ত সহজভাবে আজ সকালে ট্রেনিং গ্রাউন্ডে আমার সাথে যা হয়েছে সেটির বৃত্তান্ত তুলে ধরি।
আমার সব কথা শুনে উনি বেশ কৌতুক করেই বললেন,”ভারি কড়া তো দেখছি তোমাদের কমান্ডার সাহেব।”
আমি বললাম,”না,সেরকম কিছু নয়।আমি আসলে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়েই দ্বন্দ্বে আছি।মনে হচ্ছে,পারব তো আমি আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে?”
অফিসার হেসে বললেন,”স্বপ্নের চারাগাছ তোমার বাবা তোমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন।নিজের পরিশ্রমে এত কষ্টের পর যখন সেটিকে তুমি বেশ বড় গাছে পরিণত করতে পেরেছো,তখন তাকে বড় বৃক্ষে পরিণত করতে ভয় পাচ্ছ কেন?চারাগাছ হতে গাছ হয়ে দাঁড়ানোর পথেও তো নিশ্চয়ই অনেক বাঁধা এসেছে।তখন যেহেতু থেমে যাওনি এখন থামবে কেন?”
তার কথা শুনে আমার স্বপ্ন যেন আবার তার প্রয়োজনীয় সার পেল।
আমি উৎফুল্ল চিত্তে বলে উঠলাম,”স্যার,অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।আপনার উপদেশ আমার সবসময় মনে থাকবে।”
অফিসার প্রত্যুত্তরে বললেন,”আমার উপদেশের চেয়েও বেশি মনে রাখবে নিজের স্বপ্ন আর একে পাওয়ার সাধনার কথা এবং মনের গভীরে দেশের প্রতি ভালোবাসার প্রত্যয় থাকলে দেশের সেবা তোমার দ্বারাই হবে।আর আমাদের মোটো মনে আছে তো!”
আমি স্যালুট করে বললাম,”ইয়েস স্যার,চির উন্নত মম শির!”
এরপর নতুন উদ্যমে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার প্রত্যয় বুকে নিয়ে ডোমে ফিরলাম।
পরদিন ট্রেনিং গ্রাউন্ডে আমি আমার সর্বোচ্চটা দেই এবং ট্রেইনার আমার বেশ প্রশংসা করেন।
এভাবেই ট্রেনিং আর নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ এর মধ্য দিয়ে কাটতে থাকে দিন।
দেখতে দেখতে ছয় মাস কেটে গেল একাডেমিতে।এই ছয় মাসে যখনই আমার মনে হয়েছে আর আমার দ্বারা হবে না তখনই আমি অফিসারকে পাশে পেয়েছি।উনি যেন এই একাডেমিতে আমার গাইড হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
ছয় মাস পর আজ বাবার সাথে দেখা হবে,যদিও কিছুক্ষণের জন্যে।আমি বাবাকে আজ অফিসারের সাথে দেখা করাতে চাই।তাকে জানাতে চাই,তার চিন্তার কোনো কারণ নেই।তার থেকে এত দূরে এই পাহাড়ি এলাকার নির্জনতার কোলে তার মেয়ে একা নয়।একজন রয়েছেন তার সাথে অনুপ্রেরণা রূপে।
আমি তাই অফিসারকে খুঁজতে গেলাম।সব জায়গা খুঁজেও তাকে না পেয়ে অবশেষে তার রুমের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
পথে একজনকে অফিসার বিজয়ের রুম কোনটা জিজ্ঞেস করতেই সে বলল,”এই নামে কোনো অফিসার তো এই একাডেমিতে নেই!”
আমি অবাক হয়ে গেলাম,পরক্ষণেই ভাবলাম হয়তো নতুন তাই জানে না।এরপর প্রায় সব স্টাফকে জিজ্ঞেস করে একই উত্তর পাওয়ার পর অবশেষে এক পুরোনো স্টাফ আমাকে বললেন,”আচ্ছা তুমি এই নাম শুনেছ কোথায়?”
আমি বললাম,”শুনেছি মানে!আমি তো ওনাকে চিনি।”
স্টাফটি অবাক হয়ে বললেন,”এটি কি করে সম্ভব?উনি তো এখানকার কমান্ডার ছিলেন আজ থেকে প্রায় বিশ বছর পূর্বে।অনেক নামকরা ও ভালো একজন অফিসার ছিলেন।সব ক্যাডেটরা ওনার ভক্ত ছিল।আমি যখন চাকরিতে নতুন জয়েন করি এর কয়েক বছর পরই উনি রিটায়ারমেন্টে চলে যান।আর যতদূর জানি পাঁচ বছর আগে তিনি মারা গেছেন।রিটায়ারমেন্টের পরও উনি প্রায়ই একাডেমিতে আসতেন।বড্ড ভালোবাসতেন নিজের কাজকে।”
আমি অবিশ্বাসের স্বরে বললাম,”আমি ওনাকে স্বচক্ষে দেখেছি।এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।”
স্টাফটি আমাকে বিশ্বাস করানোর উদ্দেশ্যে আমাকে টেনে “ওয়াল অব ফেমের” সামনে নিয়ে গেলেন,যেখানে অবসরপ্রাপ্ত সব অফিসারদের ছবিসহ চাকরির পরিধি এবং তাদের কাজ ও নতুন ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে তাদের বাণী লেখা।
আমি “ওয়াল অব ফেমের” দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলাম।সেখানে আমি যার সাথে এতদিন কথা বলেছি ওনার ছবি,পাশে চাকরির সময়কাল লেখা:১৯৭৩-২০০৫।ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে তার দেয়া উক্তি-“সৈনিক দেশের অতন্দ্র প্রহরী”।
আমি যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।কিছুতেই কিছু মেলাতে পারছিলাম না।
এরপর অনেক দিন রাতে ট্রেনিং গ্রাউন্ডে আমি গিয়েছি কিন্তু আর কোনো দিনই ওনার দেখা পাইনি।
কিন্তু তার দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ আজও আমার স্বপ্নকে প্রেরণার ছায়া দ্বারা শাণিত করে চলেছে।ভাবলেই অবাক হই,কি করে একজনের দেশপ্রেম তাকে মৃত্যুঞ্জয়ী অতন্দ্র প্রহরীতে পরিণত করতে পারে!
নাম: সামিয়া চৌধুরী
ভলান্টিয়ার কন্টেন্ট রাইটার
রাইটার্স ক্লাব বিডি।